Wednesday, June 29, 2016

চাকা


মহাকাল সবে দু’পাত্তর চড়িয়ে কোয়ান্টাম কাব্যে মনোনিবেশ করে মনের এককোনায় কথা আর সুরের মধ্যে কাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় সেই নিয়ে ভাবতে বসেছিলেন, এমন সময়ে অনুপমের নতুন গানে “...আমার সব ঠাকুরেই ভক্তি...” পংক্তিটা শুনে বিষম টিষম খেয়ে একেবারে একাকার অবস্থা। সামলে উঠে গানটা মন দিয়ে শোনার আগেই খেয়াল পড়লো – এই অসময়ের অন্যমনস্কতায় তিনটে গ্যালাক্সি ধ্বসে গেছে। মহাকালের পোষা বেড়ালটা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে “ব্যানার্জি সিনড্রোম” বলে খ্যাক্‌ খ্যাক্‌ করে হাসতে হাসতে পাশের ঘরে চলে গেলো। মহাকাল ওকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। যে অবসর সময়ে দাঁতগুলো রেখে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর যার ঘন্টায় ঘন্টায় রুমাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, তাকে আমল দিতে মহাকালের বয়েই গেছে। হাতের গ্লাসটার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওটাকে টেবিলে রেখে সদ্য শেষ করা বইয়ের “Death is lighter than a feather, duty is heavier than a mountain. ডায়লগটা আউড়ে বেশ খানিক আত্মশ্লাঘা বোধ করে আবার কাব্যে মন দিলেন। মহাকালের এই সাময়িক বিচ্যুতির সুযোগে লিপযিগ গ্যালাক্সির ষষ্ঠ গ্রহের এক বনে একটা হাওয়া পাক দিয়ে উঠলো। ঝোড়ো নয়, হালকা হাওয়া। এই হাওয়া কিন্তু গল্পের শুরু নয়, শেষও নয়। কিন্তু একে একরকম শুরু বলা যেতে পারে। হাওয়া পাক দিলো ঘন বনের পাশ দিয়ে, উপলখণ্ডের উপর দিয়ে, খেত খামার ছাড়িয়ে এক ছোট্ট বাড়ির উঠোনে। এই পরিবারের জীবনে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন বোধহয় আর কখনো আসেনি।
... এই পর্যন্ত লিখে নিলয় পেনের পিছন দিকটা মুখে দিয়ে ভাবতে বসলো, যে ওর প্রথম লিখতে বসা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের শুরুটা বেশিই হালকা হয়ে গেছে কি না। পেটে বদহজম হওয়া ‘Wheel of Time’ এর থেকেও বেশি ইঞ্জিরি ছাড়া হয়ে গেছে কি না, তাই নিয়ে সামান্য দ্বিধাও দেখা দিল নিলয়ের মনে। বড় কাগজে যত্ন করে ফেঁদে বসা গল্পটা কিভাবে খেলিয়ে তোলা যায়, অথচ ঝুলে যাওয়ার উপক্রম না হয়, এ নিয়ে প্রবল চিন্তায় যখন নিলয় মগ্ন, তখন পাশের ঘর থেকে অ্যালার্ম ঘড়ির মত নিলয়ের ছ’মাসের বাচ্চাটা বেজে উঠলো। “শালা, তোর পেটের ব্যবস্থা করতেই লিখতে বসেছি রে গামবাট!” জাতীয় আরও অশ্লীল সব বাক্যবন্ধ মনের গোপনে ব্যবহার করে, মুখে ধৈর্যের অ্যাডভার্টাইসমেন্ট হতে পারে এমন হাসি ঝুলিয়ে, ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে শরীরটাকে সামান্য দুলিয়ে দুলিয়ে বাচ্চার পিঠ চাপড়ে, সাম্প্রতিক আইটেম সঙের খোকা সংস্করণটা গুন গুন করে, তাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে নিলয় যখন আবার এসে লেখার টেবিলে বসলো, ততক্ষণে ওর মাথায় প্লটের ‘প’ও আর নেই। পাশের খাটে নিদ্রিত স্ত্রীয়ের কলেবরের দিকে আড়চোখে দেখে মেজাজ এমন খিঁচড়ে গেলো, যে প্রতিজ্ঞা করে খাওয়া পঞ্চম সিগারেটের পরের ষষ্ঠটি গোপন স্টক থেকে বের করে নিলয় বারান্দায় গিয়ে ধরালো।
... এই পর্যন্ত লিখেই সুনন্দের মনে হলো, নেহাত লিখতেই হবে এই ভেবে, আর শ্রীময়ের থেকে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটা নিয়েছে বলেই যে এই কায়দায় কোন গদ্যরীতি আমদানি করতে হবে, তার তো কোন মানেই নেই! তাই কেন যে পাতাখানেক নষ্ট করা হলো এই ভেবে সুনন্দ খানিক ভাবুক হয়ে পড়লো। হস্টেলের ঘরের জানালা দিয়ে যে মাঠটা দেখা যায়, সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া কুকুরের ডাকটাও কেমন যেন ‘ওঃ! কি আমার লেখক রে!’ গোছের বিদ্রূপাত্মক শোনালো। জগতের ক্রমবর্ধমান রোশনাইয়ে অবশিষ্ট রহস্যগুলো কেন যে মুছে যাচ্ছে, সব চলে গেলে কি নিয়েই বা লিখবো – ধরনের আলগা ফেনাবাসী ক্রাইসিস আক্রান্ত হয়ে আদর্শ অসফল বুদ্ধিজীবির মতো সুনন্দ স্বগতোক্তি করলো, “কোনো শালা প্রতিভার দাম দিতে জানে না!” এই বলে আরও পাঁচটা অসমাপ্ত কাজের মত লেখাটা ফেলে রেখে আয়নায় অন্যমনস্ক আত্ম-প্রতিবিম্ব পর্যবেক্ষণ করতে করতে চুলে হাত বোলাচ্ছে, এমন সময়ে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। কেত নিয়ে ‘কাম ইন!’ বলেই নিজের ভুল বুঝতে পারলো সুনন্দ, আর একটু তাড়াতাড়িই দরজার ছিটকিনি খুলে দিলো। আগন্তুক নিজেকে হস্টেলের কেয়ারটেকার বলে পরিচয় দিলেন আর পর্যাপ্ত ভদ্রতার সঙ্গে বলে দিলেন যে আগামী এক মাসের মধ্যে সে যেন পাততাড়ি গুটিয়ে কোথাও বিদেয় হয়। পিত্তি গেলে যাওয়া মাছের পেটি চিবোনোর মত মুখ করে দরজা লাগিয়ে সুনন্দ যখন খাটে এসে বসলো, তখন কোথায় সংগ্রামী লেখকের যুদ্ধ, কোথায় পেটরোগা দর্শন – দৃশ্যতই চাপ খেয়ে চুল হয়ে যাওয়া সুনন্দ আনমনে গান ধরলো। আজকেই শোনা গান, জুনিয়র একজন শুনিয়েছে, অনুপমের “...আমার সব ঠাকুরেই ভক্তি”...
...আধঘন্টার মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার একই গানের একই লাইন শুনে একই ভাবে বিষম খেয়ে মহাকালের মেজাজ যা হলো, তাতে অন্তত আন্তর্নক্ষত্রপুঞ্জ কোনো সালিশি করা যায় না। কোয়ান্টাম কাব্যি মাথায় উঠেছে, এখন কি নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত – ভুঁইফোড় আঁতেলের লঘু জীবনদর্শন, নাকি সমলিঙ্গ যৌনতা নিয়ে হালকা উদ্দীপনা, এ সব ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে মহাকাল সময়ের চাকায় বার পাঁচেক দম দিয়ে চাইনিজ অর্ডার করে একটা বিড়ি ধরিয়ে মহাপদ্মে হেলান দিলেন। নামেই মহাপদ্ম, কয়েক বিলিয়ন বছরের ঘাম লেগে তৈরি হওয়া তেল চটচটে গন্ধটায় নাক সইয়ে নিতে নিতে ওঁর আর খেয়াল ছিলনা, যে আপন মনে গুনগুন শুরু করেছিলেন, “... আমি সেদ্ধভাতে আছি ভাই, রক্তপাতে নেই...” অলক্ষিতে এই গুঞ্জনের ফলে সৃষ্টি হওয়া মহানাদের রেসোন্যান্সে খানচারেক নেবুলা যে মিলিয়ে গেল, সেটা আর ভদ্রলোকের চোখে পড়েনি। যুগযুগান্তব্যাপী এই ভীষণ একঘেয়ে কাজটায় এমন ভুল হতেই পারে। লাভের মধ্যে, ওই রেসোন্যান্স ক্ষয় পেতে পেতে যখন লিপযিগ গ্যালাক্সির ষষ্ঠ গ্রহের বনের পাশে পৌঁছলো, তখন সেখানে ঝড় উঠেছে...

...এই পর্যন্ত লিখেই,...