Saturday, November 26, 2022

টুকরো-টাকরা

 ১)

রোজিদি কাজ করতো আমাদের বাড়ি। মুসলিম। ঘর ঝাঁট দিতো, মুছতো। রান্নাঘরে কিছু করতো না। ঠিকে কাজ করতো। মাটিতে বসে খেতো। আলাদা থালা-গ্লাস ছিলো। মা বলে দিয়েছিলো। 

রোজিদি ঘর ঝাঁট দেয়, ভাই রোজিদির পিঠে উঠে পড়ে। ঘোড়া-ঘোড়া খেলবে। গোটা মানুষ। ছোঁয়া-ছানি নেই। শুধু ঠাকুর-আসনের ধারেকাছে না।

আমি বুঝতাম না। অমন তো ছোটো থেকেই দেখছি। অমনই হয়। নিয়ম। 

বড় হয়ে বুঝলাম। আমরা — বিশেষ করে মা, প্রাচীনপন্থী ছিলেন। ছোঁয়াছানি মানতেন। ভাতের এঁটো মানতেন। আমি, বাবা, ভাই হাসাহাসি করতাম। বাঙালি এইজন্যেই এগোতে পারে না। কাঁকড়ার জাত বলে সবাই। হিন্দুকে মুসলিম টেনে ধরে, কায়েতকে বামুন, এসসি-কে ওবিসি। জাতপাতের ঊর্ধে উঠলেই মোক্ষ।

মহানন্দায় জল গড়ালো। আমি বড় হলাম, নাস্তিক হলাম। পড়ে, ভেবে, বুঝে। মানি না জাতপাত, ছোঁয়া-নাড়া — জাতের নামে বজ্জাতি সব। আমার সব খোলা মনের বন্ধু হলো। পরিচিতের সংখ্যা বাড়লো। সবাই, সব্বাই খুব পড়াশুনো করে, খুব প্রগতিশীল (কেউ কেউ ভেতর ভেতর আলাদারকম, পৈতে-টৈতে নিয়ে খুব হিট খায়)। কেউ কোনো জাতপাত মানে না। মানবধর্মে বিশ্বাস।

সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা।

সব্বাই কী সুন্দর সমান হয়ে যেত, বাঙালি কেমন জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিত — শুধু দেখুন, 

কোত্থেকে সব সেকু, মাকু, তিনু, চাড্ডি, নোভোট্টু, বুদ্ধিজীবি, তরমুজ, চটিচাটা — একগাদা এসে জুটেছে। এগুলো যে কেন একরকম হয়ে যায় না! তাহলেই তো বাঙালিকে আর কেউ আটকাতে পারতো না! একই বৃন্তে আমরা মালা হয়ে ঝুলতাম!

আমারও, কত্ত, কত্তগুলো বন্ধু থাকতো!

২)

আমি লজ্জিত, যে কলকাতা শহরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে উচ্চকিত না হলেও, যথেষ্ট গর্ববোধ করে - শেষে নীরদ সি-কেই সত্য প্রমাণিত করলাম।

সঙ্গের লেখার লেখকের ক্ষোভ যথাযথ। আমরা আত্মবিস্মৃত, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা বলে এইরকম!

লেখাটা (লিঙ্ক কমেন্টে) পড়ার পর ইন্টারনেট ঘাঁটতে বসলাম।

দিলীপ মহলানবিশের উইকির অবস্থা ( https://en.wikipedia.org/wiki/Dilip_Mahalanabis?wprov=sfla1 ) শোচনীয়। 

https://www.thebetterindia.com/.../forgotten-bengal.../ - এই লিঙ্কের লেখাটিতে বেশ কিছু নতুন তথ্য আর ছবি আছে। গুরুচন্ডা৯র লেখায় নাম নেই, এমন একজন - ডাক্তার হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির নামও জানলাম এর থেকেই, যিনি নাকি allegedly বর্ণ -বৈষম্যের শিকার ছিলেন। তাঁর উইকির অবস্থাও তথৈবচ। 

আরেকটি লেখা, দ্য প্রিন্টে বেরিয়েছে আগে -

https://theprint.in/.../when-celebrating-50-yrs.../611718/

শম্ভুনাথ দে-র উইকি বেটার। সেখানে নেই, এমন আর-একটা লিঙ্ক থাকলো NCBI-এর -

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3089041/

দ্য ওয়্যারের আর্টিকলটাও থাকুক এখানে-

https://m.thewire.in/.../remembering-sambhu-nath-de-the...

গুরু-তে এ নিয়ে আগের একটা লেখা- https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=19142


৩)

সরকারি কাজে হিন্দি ব্যবহার করতে হবে — এই দাবির ভালোমন্দ বিচার করতে গিয়ে আপনার মনে হতেই পারে, এ তো আসলে 'ইংরেজি-র বদলে' হিন্দির ব্যবহার — এতে আবার খারাপ কী হল?

খারাপ হত না, যদি উদ্দেশ্য সৎ হত। বহুভাষী এই দেশের প্রতিটি নাগরিক যাতে অন্তত দুটো ভাষায় সড়গড় (বাইলিঙ্গুয়াল) হন, সেই উদ্দেশ্যে কাজটা করা হত। সেক্ষেত্রে এই নির্দেশটি কেমন শোনাতো? 

অনেকটা এইরকম — "সরকারি কাজ, যে কোনো নাগরিক, তাঁর নিজের মাতৃভাষায় অথবা এই তিন/চার/পাঁচটি ভাষার মধ্যে যে কোনো একটিতে সম্পন্ন করতে পারবেন। যদি তাঁর মাতৃভাষায় উপযুক্ত লিপি না থাকে, অথবা সেই ভাষাটি এখনও সরকারি কাজে ব্যবহৃত হওয়ার স্বীকৃতি না পেয়ে থাকে, তবে অমুক নম্বরে অভিযোগ করুন.."

অর্থাৎ, মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার আর কোনো একটি 'সংযোগের ভাষা' বেছে নেওয়ার অধিকার সেই নাগরিকের থাকলো। 

এ না করে, 'সব কাজে হিন্দি ব্যবহার করো' বললে, তা, এক চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করতে আরেক চাপিয়ে দেওয়াই তো হয়, তাই না? এবার প্রশ্ন হল, তা কি এই নিয়মের প্রবক্তারা বোঝেন না? বোঝেন। কিন্তু ওই যে বললাম, তাঁদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। যে বিরক্তি আন্তর্জাতিক স্তরে ইংরেজির জন্যে বরাদ্দ রাখা যায়, সেটারই দেশি সংস্করণ যে হিন্দির জন্যেও রাখা প্রয়োজন, সেটা JNU তে ১৫-২০ দিনের যে কোনো কোর্স করলেই বোঝা যাবে। বোঝা যাবে, এই যে "ইংরেজির বিপরীতে হিন্দি রাখা হল" — এটা সম্পূর্ণ গো-বলয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। কারণ, একদিকে, তারা কনফারেন্সে 'Bilingualism' নামে কাঁদে (অর্থাৎ, প্রতিটি বক্তাকে ইংরেজি-হিন্দি দুই ভাষাতেই বলতে বলে), অন্যদিকে ২য় ভাষাটি হিন্দির বদলে কোনো প্রাদেশিক ভাষা হলে — বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের কোনো রাজ্যের হলে — দিশি রেসিজম লকলক করে ওঠে। তারা নিজেরা বক্তৃতা দেওয়ার সময়? 'হিন্দি-না-বোঝা' জনতার জন্যে এক লাইনও ইংরেজি বলে কি? না মশয়, বলে না। সাধারণ মানুষের কথা বলছি না — BHU-এর ফ্যাকাল্টির কথা হচ্ছে, JNU-এর বড়কর্তাদের কথা হচ্ছে। নীতি-প্রণয়ণে, হিন্দি আগ্রাসনে, NEP-র নামে গোবর-মাহাত্ম্য বিস্তারে যারা সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকে।

অতএব, এই ব্যাপারটি ঠিক 'ইঞ্জিরির বিরুদ্ধে' নয়, ওই আদ্যিকালের 'এক দেশ, এক ভাষা'-রই রকমফের — যার পক্ষে এককালে রবীন্দ্রনাথও সওয়াল করেছিলেন। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের বিশ্বজিৎ রায়ের একটি লেখার শুরুর কয়েক লাইন তুলে দিই— "এক ভাষা আর এক দেশের কথা বলে দেশকে হিন্দি-হিন্দুত্বের শিকড়ে আর ঐতিহ্যে ফেরানোর কথা বলছেন যাঁরা, তাঁরা আসলে জানেন না, এই এক ভাষা আর এক দেশের আদলটা আসলে বিলিতি। এই পোড়া দেশে আমরা কিছুই মনে রাখি না। পূর্বজরা হাত পুড়িয়ে যা শিখেছিলেন, আমরা তা ভুলে যাই, আবার ঘরে আগুন লাগাতে উদ্যত হই।..." এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিবর্তন নিয়ে জানতে চাইলে, আসল লেখার লিঙ্ক নীচে/কমেন্টে দেওয়া থাকলো।

এই সাম্প্রতিক হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখা একটি লেখায় একজন পরিচিত দেখলাম মন্তব্য করেছেন, ইংরেজি এতটাই বেশি বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে তার উল্টোদিকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রাখলেও ভালো লাগে। 

এই 'চটজলদি' প্রতিক্রিয়ার একটা ভয়ানক বদ ফলাফল আছে। একটা গল্প বলি এই প্রসঙ্গে (না বললেও আপনারা ভালোই বুঝতেন, নেহাত গল্পটা বলবোই বলে...)।

নিউজিল্যাণ্ডে আগে খরগোশ ছিল না। মানুষ সেখানে বাইরে থেকে বসতি স্থাপন করতে গিয়ে, মাংসের খোরাক হিসেবে, সঙ্গে করে খরগোশ নিয়ে যায়। মার্কেটে কোনো প্রাকৃতিক 'খরগোশ-শিকারি' না থাকায়, খরগোশেরা, ইয়ে মানে, খরগোশের মতো গতিতেই বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে। ইকোসিস্টেমের বারোটা বাজার আগেই এর একটা ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে, খরগোশের এক 'শিকারি', ফেরেট (বেজি-টাইপের) নামক আর এক রোমশ প্রাণীকে সেখানে নিয়ে আসা হয়। খরগোশের 'বিরুদ্ধে' আনা হলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, খরগোশ-শিকারে এই ফেরেটদের কোনো উৎসাহই নেই, বরং তারা নির্বিচারে আঞ্চলিক (এবং সংরক্ষিত) প্রাণী ধরে খেতে থাকে, কারণ তাদের অপেক্ষাকৃত সহজে শিকার করা যায়। বর্তমানে, খরগোশের সংখ্যা তো কমেইনি, ফেরেটরাও একই তীব্রতায় বংশবৃদ্ধি করেছে আর যে প্রাণীদের 'বাঁচানোর' কথা ভেবে ফেরেট আনা হয়েছিল, তারা বিলুপ্তপ্রায়। ফলত, নিউজিল্যান্ড সরকারের মাথায় হাত।

গল্পটি শিক্ষণীয় হোক, না হোক — আসল কথা হল,

যে কোনো ভাষার উলটোদিকেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রাখলে ভালো লাগে। সবারই। ইনক্লুসিভিটির পরিচায়ক তো। হিন্দি রাখলে ততটা লাগে না। কারণ, ক্ষতি আখেরে আমাদেরই।

হিন্দির এই আগ্রাসন যে আজকের নয়, সে কথা সকলেই জানে, তবে এই বছরের শুরুর দিকে এইবারের সাম্প্রতিকতম চেষ্টাটা শুরু হয়েছিল অমিত শাহ-এর হাতে। তার প্রতিক্রিয়ায় বেরোনো আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় থেকে এই উদ্ধৃতিটি দিয়ে ত্যানা প্যাঁচানো শেষ করি —

"ভাষা হিসাবে হিন্দি গুরুত্বহীন, এমন দাবি করার প্রশ্ন নেই। সেই ভাষার বিকাশ ঘটলেও তাতে কেউ আপত্তি জানাবেন না। কিন্তু, যে দেশ ঐতিহাসিক ভাবে বহুভাষী, তার উপর কোনও কৌশলেই হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি, পারস্পরিক সংযোগের ভাষা হিসাবে ব্যবহারের আপাত-নিরীহ পরামর্শের মাধ্যমেও নয়। দেশের মানুষ কোন ভাষায় কথা বলবেন, দুই ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন কোন ভাষায়— সেই সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই তাঁদের। তা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহের কর্তব্য ছিল এই বহুত্বকে সম্মান করা। তিনি বলেছেন, হিন্দি ভাষাকে নমনীয়, গ্রহণশীল হতে হবে— আঞ্চলিক ভাষার শব্দ গ্রহণ করতে হবে। ভাষা বস্তুটি সততই চলমান, জৈব। যে কোনও ভাষাই গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে— তার জন্য সরকারি ফরমানের প্রয়োজন পড়ে না। গ্রহণশীলতা অতি উত্তম ধর্ম— বিজেপির নেতারা বরং তা অভ্যাস করতে পারেন। তা হলে দেশের বহুত্বকে তাঁদের এতখানি অসহ্য ঠেকবে না।"


Wednesday, June 29, 2016

চাকা


মহাকাল সবে দু’পাত্তর চড়িয়ে কোয়ান্টাম কাব্যে মনোনিবেশ করে মনের এককোনায় কথা আর সুরের মধ্যে কাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় সেই নিয়ে ভাবতে বসেছিলেন, এমন সময়ে অনুপমের নতুন গানে “...আমার সব ঠাকুরেই ভক্তি...” পংক্তিটা শুনে বিষম টিষম খেয়ে একেবারে একাকার অবস্থা। সামলে উঠে গানটা মন দিয়ে শোনার আগেই খেয়াল পড়লো – এই অসময়ের অন্যমনস্কতায় তিনটে গ্যালাক্সি ধ্বসে গেছে। মহাকালের পোষা বেড়ালটা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে “ব্যানার্জি সিনড্রোম” বলে খ্যাক্‌ খ্যাক্‌ করে হাসতে হাসতে পাশের ঘরে চলে গেলো। মহাকাল ওকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। যে অবসর সময়ে দাঁতগুলো রেখে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর যার ঘন্টায় ঘন্টায় রুমাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, তাকে আমল দিতে মহাকালের বয়েই গেছে। হাতের গ্লাসটার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওটাকে টেবিলে রেখে সদ্য শেষ করা বইয়ের “Death is lighter than a feather, duty is heavier than a mountain. ডায়লগটা আউড়ে বেশ খানিক আত্মশ্লাঘা বোধ করে আবার কাব্যে মন দিলেন। মহাকালের এই সাময়িক বিচ্যুতির সুযোগে লিপযিগ গ্যালাক্সির ষষ্ঠ গ্রহের এক বনে একটা হাওয়া পাক দিয়ে উঠলো। ঝোড়ো নয়, হালকা হাওয়া। এই হাওয়া কিন্তু গল্পের শুরু নয়, শেষও নয়। কিন্তু একে একরকম শুরু বলা যেতে পারে। হাওয়া পাক দিলো ঘন বনের পাশ দিয়ে, উপলখণ্ডের উপর দিয়ে, খেত খামার ছাড়িয়ে এক ছোট্ট বাড়ির উঠোনে। এই পরিবারের জীবনে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন বোধহয় আর কখনো আসেনি।
... এই পর্যন্ত লিখে নিলয় পেনের পিছন দিকটা মুখে দিয়ে ভাবতে বসলো, যে ওর প্রথম লিখতে বসা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের শুরুটা বেশিই হালকা হয়ে গেছে কি না। পেটে বদহজম হওয়া ‘Wheel of Time’ এর থেকেও বেশি ইঞ্জিরি ছাড়া হয়ে গেছে কি না, তাই নিয়ে সামান্য দ্বিধাও দেখা দিল নিলয়ের মনে। বড় কাগজে যত্ন করে ফেঁদে বসা গল্পটা কিভাবে খেলিয়ে তোলা যায়, অথচ ঝুলে যাওয়ার উপক্রম না হয়, এ নিয়ে প্রবল চিন্তায় যখন নিলয় মগ্ন, তখন পাশের ঘর থেকে অ্যালার্ম ঘড়ির মত নিলয়ের ছ’মাসের বাচ্চাটা বেজে উঠলো। “শালা, তোর পেটের ব্যবস্থা করতেই লিখতে বসেছি রে গামবাট!” জাতীয় আরও অশ্লীল সব বাক্যবন্ধ মনের গোপনে ব্যবহার করে, মুখে ধৈর্যের অ্যাডভার্টাইসমেন্ট হতে পারে এমন হাসি ঝুলিয়ে, ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে শরীরটাকে সামান্য দুলিয়ে দুলিয়ে বাচ্চার পিঠ চাপড়ে, সাম্প্রতিক আইটেম সঙের খোকা সংস্করণটা গুন গুন করে, তাকে ঘুম পাড়িয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে নিলয় যখন আবার এসে লেখার টেবিলে বসলো, ততক্ষণে ওর মাথায় প্লটের ‘প’ও আর নেই। পাশের খাটে নিদ্রিত স্ত্রীয়ের কলেবরের দিকে আড়চোখে দেখে মেজাজ এমন খিঁচড়ে গেলো, যে প্রতিজ্ঞা করে খাওয়া পঞ্চম সিগারেটের পরের ষষ্ঠটি গোপন স্টক থেকে বের করে নিলয় বারান্দায় গিয়ে ধরালো।
... এই পর্যন্ত লিখেই সুনন্দের মনে হলো, নেহাত লিখতেই হবে এই ভেবে, আর শ্রীময়ের থেকে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটা নিয়েছে বলেই যে এই কায়দায় কোন গদ্যরীতি আমদানি করতে হবে, তার তো কোন মানেই নেই! তাই কেন যে পাতাখানেক নষ্ট করা হলো এই ভেবে সুনন্দ খানিক ভাবুক হয়ে পড়লো। হস্টেলের ঘরের জানালা দিয়ে যে মাঠটা দেখা যায়, সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া কুকুরের ডাকটাও কেমন যেন ‘ওঃ! কি আমার লেখক রে!’ গোছের বিদ্রূপাত্মক শোনালো। জগতের ক্রমবর্ধমান রোশনাইয়ে অবশিষ্ট রহস্যগুলো কেন যে মুছে যাচ্ছে, সব চলে গেলে কি নিয়েই বা লিখবো – ধরনের আলগা ফেনাবাসী ক্রাইসিস আক্রান্ত হয়ে আদর্শ অসফল বুদ্ধিজীবির মতো সুনন্দ স্বগতোক্তি করলো, “কোনো শালা প্রতিভার দাম দিতে জানে না!” এই বলে আরও পাঁচটা অসমাপ্ত কাজের মত লেখাটা ফেলে রেখে আয়নায় অন্যমনস্ক আত্ম-প্রতিবিম্ব পর্যবেক্ষণ করতে করতে চুলে হাত বোলাচ্ছে, এমন সময়ে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। কেত নিয়ে ‘কাম ইন!’ বলেই নিজের ভুল বুঝতে পারলো সুনন্দ, আর একটু তাড়াতাড়িই দরজার ছিটকিনি খুলে দিলো। আগন্তুক নিজেকে হস্টেলের কেয়ারটেকার বলে পরিচয় দিলেন আর পর্যাপ্ত ভদ্রতার সঙ্গে বলে দিলেন যে আগামী এক মাসের মধ্যে সে যেন পাততাড়ি গুটিয়ে কোথাও বিদেয় হয়। পিত্তি গেলে যাওয়া মাছের পেটি চিবোনোর মত মুখ করে দরজা লাগিয়ে সুনন্দ যখন খাটে এসে বসলো, তখন কোথায় সংগ্রামী লেখকের যুদ্ধ, কোথায় পেটরোগা দর্শন – দৃশ্যতই চাপ খেয়ে চুল হয়ে যাওয়া সুনন্দ আনমনে গান ধরলো। আজকেই শোনা গান, জুনিয়র একজন শুনিয়েছে, অনুপমের “...আমার সব ঠাকুরেই ভক্তি”...
...আধঘন্টার মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার একই গানের একই লাইন শুনে একই ভাবে বিষম খেয়ে মহাকালের মেজাজ যা হলো, তাতে অন্তত আন্তর্নক্ষত্রপুঞ্জ কোনো সালিশি করা যায় না। কোয়ান্টাম কাব্যি মাথায় উঠেছে, এখন কি নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত – ভুঁইফোড় আঁতেলের লঘু জীবনদর্শন, নাকি সমলিঙ্গ যৌনতা নিয়ে হালকা উদ্দীপনা, এ সব ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে মহাকাল সময়ের চাকায় বার পাঁচেক দম দিয়ে চাইনিজ অর্ডার করে একটা বিড়ি ধরিয়ে মহাপদ্মে হেলান দিলেন। নামেই মহাপদ্ম, কয়েক বিলিয়ন বছরের ঘাম লেগে তৈরি হওয়া তেল চটচটে গন্ধটায় নাক সইয়ে নিতে নিতে ওঁর আর খেয়াল ছিলনা, যে আপন মনে গুনগুন শুরু করেছিলেন, “... আমি সেদ্ধভাতে আছি ভাই, রক্তপাতে নেই...” অলক্ষিতে এই গুঞ্জনের ফলে সৃষ্টি হওয়া মহানাদের রেসোন্যান্সে খানচারেক নেবুলা যে মিলিয়ে গেল, সেটা আর ভদ্রলোকের চোখে পড়েনি। যুগযুগান্তব্যাপী এই ভীষণ একঘেয়ে কাজটায় এমন ভুল হতেই পারে। লাভের মধ্যে, ওই রেসোন্যান্স ক্ষয় পেতে পেতে যখন লিপযিগ গ্যালাক্সির ষষ্ঠ গ্রহের বনের পাশে পৌঁছলো, তখন সেখানে ঝড় উঠেছে...

...এই পর্যন্ত লিখেই,...

Monday, September 16, 2013

'Chennai Express'ions... 1


চেন্নাইতে আসা এক মাস হয়ে গেল। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, কাছাকাছি বাজার-হাট দেখে নেওয়া, কাজ করার ঘর, টেবিল আর কম্পিউটার পাওয়া সবই মোটামুটি হয়ে গেছে, বাকি বলতে একটা সাইকেল জোগাড় করা আর প্রথম চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসা। দ্বিতীয়টা করতে গেলে প্রথমটা দরকার বলে দু’টোর কোনটাই করবো করবো করে আর করা হয়ে উঠছে না। তবু যাকে বলে সেট্‌ল্‌ করে গেছি। একটা নবীনবরণ গোছের অনুষ্ঠানও হয়ে গেছে। সোজা কথায় আমি এখন পাকাপোক্ত দক্ষিণ-ভারতের বাসিন্দা। কেমন আছি, কোথায় আছি, সেই নিয়ে নিয়মিত গল্প করবো বলেই লিখতে বসা। এর থেকে বেশি আর কোন মহৎ উদ্দেশ্য নেই।

রাতের শেষ প্রহরে ট্রেন থেকে নেমে কাজের জায়গায় আসতে গিয়েই পরিষ্কার বুঝলাম, কেন আসার আগে এত লোকে এত শোক পালন করছিল। সত্যি, শোক পালন! “যা, এবার সারাদিন কি করে দোসা-ইডলি খেয়ে কাটাস দেখি!” থেকে শুরু করে “আর যাওয়ার জায়গা পেলে না! ব্যাঙ্গালোর গেলেও বুঝতাম... চেন্নাই! খুব খাজা জায়গা ভাই, সত্যি বলছি” পর্যন্ত কত কিই না শুনলাম। যেন শখ করে জায়গা বেছেছি! ভারত সরকার কেন যে ট্যুরিস্ট-স্পটগুলোয় দেখে দেখে ইন্সটিটিউট বানায় না, হুঁহ্‌– যাক্‌, সে আর দুঃখ করে কি হবে। সব মিলিয়ে বেশ খানিকটা ভয় ছিলই, তার উপরে ভাষার অসুবিধে। ভাসা ভাসা জানা ছিল যে বহুদিন যাবৎ এখানে হিন্দির বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে – তাই কেউই ও ভাষায় কথা বলে না। জানলেও বলে না। সে ঠিক আছে। তাহলে বলেটা কি? নিশ্চয়ই ইংরেজি? তাহলেও তো অসুবিধে নেই- চালিয়ে নেবো। এইসব ভেবে দুগ্‌গা বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পৌঁছে কি দেখলাম?

Thursday, March 28, 2013

আ মোলো বাংলাভাষা


যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঘা যতীনের দিকে যেতে সুলেখা মোড় পেরিয়ে ডানদিকে একটা ‘ক্যাফে কফি ডে’র আউটলেট। বিকেলের দিকে প্রায় প্রতিদিনই ফাঁকা থাকে। স্বাভাবিক। অন্তত ইউনিভার্সিটির গড়পড়তা ছাত্র-ছাত্রীরা যে এখানে আসবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। হাতখরচের টাকা বেশি খরচ করে খেতেই যদি হয়, তবে সামান্য দূরেই সাউথ সিটি আছে, বৈচিত্র্যের পসরা সাজিয়ে। এখানে আসে প্রধানত প্রেমী-যুগল – হয় ডাক্তারি, নয় ব্যবসার পিতৃদত্ত পয়সার মালিক, নয়তো নতুন প্রেমে পড়া মধ্যবিত্ত ছোকরা – ছোটবেলায় নচিকেতার ‘...মোটা মানিব্যাগ দেখে/ তোমাকে সাইডে রেখে/ দৌড়বে সোজা, সোজা দৌড়বে প্রেম...’ কথাটায় বেজায় ভয় পেয়ে তিনদিন টিফিন না খেয়ে জমানো টাকা উড়িয়ে মেয়েটিকে ইম্প্রেস করবে বলে, নয়তো মধ্যবয়স্কা নারীর দল – সমাজ বা প্যান্টালুন্‌স কিছু একটা উদ্ধার করে শরীর জুড়োতে আসা। এখানেই বসে গম্ভীর মুখে ল্যাপটপ খুলে দেশোদ্ধার করার ভান করছি। আসলে কিন্তু কান পড়ে আছে পাশের টেবিলে ট্যাঙ্ক-টপ আর হোঁৎকা বয়ফ্রেন্ডের অধিকারিণী চটকদার মেয়েটির কথার দিকে।

আজকের লেখার বিষয় এই কফিশপ-বিশ্বায়ন হতে পারতো – ‘আহা আমাদের কফি-হাউসের কি হবে গো!’ বলে চাড্ডি কান্নাকাটি করার সুযোগ থাকতো। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কি করে তরুণ সমাজের পকেটের গভীরতায় প্রতিফলিত হয়, সে নিয়ে পাঁচ পাতা প্যাঁচানো যেত। এমন কি ওই হোঁৎকা ছেলেটির ক্রমবর্ধমান মেদপুঞ্জ আসলে কিভাবে মুক্ত-বাণিজ্যের ষড়যন্ত্র আর ষড়রিপুর ফল, সে নিয়েও কিছু বিদ্যে ফলানো যেত – কিন্তু এ সব মাটি করল ওই মেয়েটা। 

প্রথমে খেয়াল করিনি। আধা-ইংরেজি, আধা হিন্দিতে বকবক শুনে ভেবেছিলাম