Wednesday, January 18, 2012

গণ-পতি



৭৭ পাটায়া প্লেসে আজ অনেক লোক। সাদায় সেজেছে পুরো বাড়ি। এমনকি সামনের বাগান থেকেও কে যেন সবক’টা ফুল অনেক সকালে তুলে নিয়েছে। বাগানের মালি, বাড়ির কাজের লোক, রান্নার ঠাকুর- সকলেই সাদা ইউনিফর্ম পরে ফেলেছে। বাইরের লন থেকে ভিতরের ঘর- সর্বত্র ধূপ জ্বলছে- ধূপকাঠি নয়, মোটা মোটা ধূপ- সুগন্ধি। গম্ভীর মুখে যাতায়াত করছেন অনেক মানুষ। গম্ভীর, কারণ আজ কোন উৎসব নয় এখানে- শোকপালন। আজ এই নতুন বাড়ি প্রথম শোকের মুখ দেখলো।

দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটায় বসেছিলেন আগরওয়াল-গিন্নী গোমতী। বয়স ছাপ্পান্ন, ওজন ৪৮ (ডায়াবেটিক), মেজাজ তিরিক্ষে। নেহাত আজকের দিনে চিৎকার-চেঁচামেচি করলে লোকে কি বলবে, তাই গলার আওয়াজটা কম আছে। সঙ্গিনীরা ঘিরে বসে আছে, প্রায় জনা দশেক। সকলেই গত ঘন্টাখানেক ধরে শোক-জ্ঞাপন আর সান্ত্বনা-দানের পর সামান্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সবথেকে বেশি বয়সের জনাতিনেক ঘরের একেবারে পিছনে বসে নিজেদের বাস্তব ও কাল্পনিক নানাবিধ রোগ ও তার বাস্তব ও কাল্পনিক চিকিৎসা নিয়ে নিচুগলায় গল্প করে চলেছেন। এমতাবস্থায় আর কিছুক্ষণ চলতে দিলে অচিরেই যে তাঁর আসরের মধ্যমণির অবস্থানটা চলে যাবে, সেটা বুঝতে পেরেই জোরে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন গোমতী দেবী-

-‘...সে অবশ্য আমি প্রথম দিন থেকেই জানতাম যে এমন কিছু একটা হতে চলেছে। কিন্তু এত দুঃখ দেবেন গণপতি তা তো জানা ছিলোনা! এ সব আসলে আমারই পাপের ফল।’

হাঁ হাঁ করে উঠলো ঘিরে বসা জনা চার সখী। সকলেই গৃহবধূ, ধনী ব্যবসায়ী পত্নী। আদতে সাদা কাপড় পরা থাকলেও তাতেও হাল-ফ্যাশনের মুক্তোর সাজ করে এসেছেন অনেকে। কেউ কেউ ‘কন্ট্রাস্ট’ বজায় রাখতে নিজেদের সধবা অবস্থার চিহ্ন-সূত্র টি পরে এসেছেন। সরযূদেবী, তিনিই সবথেকে নিকট বন্ধু, খেই ধরে ফেললেন-

‘সে আবার কি কথা? তোর পাপের ফল কেন হবে? প্রত্যেকে নিজের কাজের হিসেব নিজেই মেটায়। আমি কি জানিনা তুই কত চেষ্টা করেছিলি এই অনাচার আটকাতে?’

দলের সর্বশেষ সংযোজন চম্পা- এখনো দেবী হয়ে উঠতে পারেনি। বয়স ৩৫, দেখে ৩০ এর কম মনে হয়। হয়তো সেই কারণেই একটু কড়া ব্যবহার করা হয় ওর সঙ্গে। ও কিছু জানেনা, তাই জিগ্যেস করে বসলো- ‘কি অনাচার দিদি?’

সরযূ কড়া চোখে একবার তাকিয়েই মুখ ঘোরালেন গোমতীর দিকে- তিনি তখন বলে চলেছেন-

‘আমি জানিনা, কার দোষ। শুধু জানি, ছেলে মানুষ করায় আমার কোন গলতি ছিলো না। নিজের সারা জীবন দিয়ে দিয়েছি এই সংসারের পিছনে- সে কি আজকের এই দিন দেখতে হবে বলে? পই পই করে বলেছিলাম- করিস না, বিয়ে করিস না; প্রেম-ভালবাসা এক জিনিস আর ভগবান আরেক। ওই মাছ-মাংস খাওয়া বাঙালি মেয়ে কে বিয়ে করে এনে আমার ঘরে যেদিন ঢুকিয়েছে- সে দিনই গণপতি চলে গেছেন এই বাড়ি থেকে... তাও তিনি ক্ষমাশীল- কিন্তু কি সাহস! বাপের বাড়ি গিয়ে ওই দুধের ছেলের মুখে মাছ দিয়েছে! আমি ফোন করায় মুখে মুখে চোপা- “কেন মা, আমার মা বাবা তো খান, তাঁরা কি মানুষ নন”! ঘোর কলি না হলে সে দিনই তোর কোল ফাঁকা হয়ে যেত। দেখ এখন কেমন লাগে...’

কথার স্রোত বন্ধ হলো সরযূ তাঁর মুখে হাত চাপা দেওয়ায়। ‘থাম্‌ গোমতী! আজকের দিনে আর একবারও ও’কথা মুখে আনবিনা। তোকে আমার দিব্যি...’

বন্ধুর স্বাস্থ্যই হোক বা চক্ষু লজ্জা, গোমতী চুপ করলেন। তাঁর শোক মিথ্যা নয়। সত্যিই তিনি বিশ্বাস করেন তাঁর নাতির মৃত্যুর কারণ এটাই। সারা ঘরে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো- ফাঁকে ফাঁকে কিছু সান্ত্বনা বাক্য। আর আধ-ঘন্টার মধ্যেই এটা বাঙালি-নিধন যজ্ঞে গিয়ে দাঁড়াবে।



বারো বাই চোদ্দ ফুট ঘরে আসবাব বলতে একটা ছোট দোলনা- খাঁচা, একটা বড় ওয়ার্ড্রোব, একটা টেবিল আর একটা মিনি চেয়ার। দেরাজের পাল্লা হাট করে খোলা, ভিতরে একটাও কাপড়-জামা নেই। ছিল- একটা ছোট মানুষের জামাকাপড়ে ভর্তি ছিল পুরোটা। এইমাত্র পুত্‌লিবাঈ বড় বস্তায় করে সব নিয়ে চলে গেলো। যেতে যেতে অনেক কথা বলছিলো- দুঃখপ্রকাশ যেমন ছিল তাতে, আশির্বাণীও ছিল- ভাল করে শোনেনি নিখিল। শুনতে ভাল লাগছিলো না। মাথাটা ধরে আছে সকাল থেকে। আগরওয়াল খানদানের ছেলেকে প্রকাশ্যে কাঁদতে নেই। তাই স্নান করতে গিয়ে জোরে কল চালিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কেঁদেছিল নিখিল। সেই থেকে মাথাটা ধরে আছে।

আপাতদৃষ্টিতে খুলে রাখা দেরাজের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে মনে হলেও নিখিল আসলে তাকিয়ে ছিলো ওপরে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে। মুদি দোকানের সাধারণ ক্যালেন্ডার- গণপতির ছবি দেওয়া। কোন এক সময়ে গোমতী ঝুলিয়ে দিয়েছিল। যদিও সারা জীবন ঈশ্বর নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানোর সুযোগ হয়নি নিখিলের, আর যদিও সে বিশ্বাস করেনা পৌত্তলিকতায়, তা-ও শিশুকাল থেকে ওই গণপতি আর ঈশ্বর ওর কাছে সমার্থক। তাই গণপতির সঙ্গেই মনে মনে কথা বলছিল ও।

কেন হলো এমন? কার দোষের ফল পেল ওই নিষ্পাপ ছেলেটা? জ্ঞানতঃ কখনো এমন কিছু করেনি নিখিল যার শাস্তি এটা হতে পারে। করেনি? তবে কি ওই এক শীতের ওই এক ঘটনা তাড়া করে বেড়াবে ওকে সারা জীবন? কেউ কিচ্ছু জানেনা- সেটা নিশ্চিত জানে নিখিল। জানার কথাও নয়। তবু- শ্যামলীর মুখের দিকে তাকাতে এত ভয় হচ্ছে ক’দিন। কে জানে, হয়তো মুখে ফুটে উঠছে মনের অপরাধবোধ। সত্যিই কি এতটাই দোষ? অন্তত তিনজন কে চেনে ও এ পাড়ায়, যারা একবার না একবার এ কাজ করেছে। জানেনা, এমন লোকের সংখ্যা নিশ্চিত আরও বেশি। তবু ভয় যাচ্ছে কোথায়? গণপতি- কি করবো আমি? কি করলে নামবে এই পাপের বোঝা?

সামনের জানালা দিয়ে আসা আলোর বৃত্তটা এসে পড়লো পিছনের আয়নায়। মুহূর্তে তার প্রতিবিম্ব এসে পড়লো উলটো দিকের দেওয়ালে- মানে নিখিলের সামনে। এসে পড়লো ঠিক গণপতির এক চোখে। যেন মনে হলো কাগজের গণপতি এক চোখ বুজলেন।

এতক্ষণ ধরে যে চিন্তাটা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো নিখিলের মাথায়, সেটাই কি তবে ঠিক? তবেই ক্ষমা পাওয়া যাবে? –উঠে বসলো নিখিল। মিনিট-খানেক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর উঠে হাঁটা দিলো বাইরের ঘরের দিকে। এখুনি, এখুনি বলতে হবে শ্যামলী কে- বছর দুয়েক আগের এক রাতের কথা- যে রাতে নিখিল ঠকিয়েছিল তার ভালবাসার বউ কে। ও নিশ্চিত, ক্ষমা করবেন গণেশ......

শ্যামলী করবে কি?



শীত আসছে। হাওয়ায় কনকনে ভাব দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে গত ক’দিন ধরে। ঘরে পাঁচটা বাচ্চা- তার মধ্যে একটার  বয়স চার। তার একটাও শীতের জামা নেই। ওর চেয়ে বড় মেয়েটারও একই অবস্থা। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম চলে গেছিল পুতলির। আবার যদি ওর বাচ্চা মারা যায়- এ জীবনই আর রাখবে না বলেছিল ওর বর কে। এক মাস ধরে দিনে রাতে প্রার্থনা করার পর আজ মুখ তুললেন ভগবান- আর কি অদ্ভুত ভাবে! পিঠের বস্তার ভারে চলা যায়না- এত জামাকাপড়। তবু আনন্দে একবার উপরের দিকে তাকিয়ে হেঁকে উঠলো পুত্‌লিবাঈ- “গণপতি বাপ্পা মোরিয়া...!”

No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P