Wednesday, October 17, 2012

অসুখ-বিসুখ



একটা মজার গল্প শুনবেন? মানে, মজা কতটা লাগবে জানিনা, তবে গল্পটা অনেকটা সত্যি, আর বেশ গোলমেলে। শেষ অবধি মজা পেয়ে গেলে আমাকেই দোষ দেবেন ’খন। গল্পের চরিত্রদের নাম বদলেই দিচ্ছি- প্রায় সত্যি ঘটনা কিনা!

পূর্ব ভারতের একটা বড় শহর। খুব বেশি বড় নয়, তবে পুরনো হওয়ার সুবাদে জনসংখ্যা সহ্যের থেকে বেশি। ঘিঞ্জি, অল্প নোংরা- কিন্তু তার জন্য কি আর লোকসংখ্যা কমেছে কোনকালে ভারতে? তা, সেই শহরে অনেক ডাক্তার। নানা বিষয়ের, নানা রোগের বিশেষজ্ঞ পুরনো, নতুন, কচি, পোড়খাওয়া- পুরো বর্ণালী পাওয়া যায় এখানে। আশপাশের বিরাট বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোন ভাল হাসপাতাল নেই- এদিকে এখানে একটা ডাক্তারি কলেজ পর্যন্ত রয়েছে। রুটির ওপর ব্যাঙের ছাতার মতো তাই নিশ্চিতভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওষুধের দোকান- ভাল কথায় কেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট, প্যাথোলজি ল্যাব এটা-সেটা-রা এটা-সেটা-রা।

এগুলো হলো সেই সব জিনিস, যা জনগণের চোখের সামনে থাকে। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজার যাওয়ার সময় নতুন গজিয়ে ওঠা দু’টো ওষুধের দোকান দেখে কাকা-জ্যাঠারা মন্তব্য করেন-“এত ডাক্তার, এত দোকান- কিন্তু তিন বছর ধরে কোমরের ব্যথার চিকিচ্ছে করতে পারলো না ব্যাটারা- চোরের দল সব”। অথবা, “দেখছিস কি? এই হচ্ছে গ্লোবালাইজেশনের ফল, বুঝলি! আমাদের ছোটবেলায় হরেনপিসে দুটো-চারটে গুলি দিয়ে দিতেন, একদিনে চাঙ্গা। এখন? পুরো পেনশন শেষ হয়ে যাবে, তবু শরীর ঠিক হয় না মড়া!”। এসব কথা কতটা অভিজ্ঞতার ফল আর কতটা বিরক্তির বিষ- সে নিয়ে তর্কে না ঢুকেই এটুকু বলা যায়, যে এ সমস্তই হিমশৈলের উপরেরটুকু মাত্র।

চোখে যা দেখা যায়না, তার অনেক রকম, অনেক গড়ন। গল্পকে মহাভারত না বানিয়ে আমরা তাই ততটুকু বলবো, যা গল্পের প্রয়োজনে লাগে।


আমাদের হিরো, প্রণব- ওর বন্ধুদের মতো আমরাও ওকে পেনো বলেই ডাকবো, চা খাচ্ছিলো সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মেসের বিছানায়। গতরাতের মাছভাজাটা খেয়ে অল্প অ্যাসিড হয়েছে, তার ওপর ডান হাতের তালু থেকে কাঁধ অবধি কনকনে ব্যথাটা তো আছেই। সব্বাই বলছে বাইক চালানোর ফল, কিন্তু ডাক্তার দেখিয়ে চেক-আপ করানো হচ্ছেনা মোটেই। অথচ ডাক্তার দেখানো কোনো ব্যাপারই নয়। প্রত্যেকে ওকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। অনেকে তো প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই। তবু তাদের কাছে গিয়ে প্রোডাক্টের কথা, ইন্সেন্টিভের কথা না বলে নিজের রোগের কথা বলতে বেজায় বাধে পেনোর। এদিকে বাইক চালানো তো আর থামানো যায় না- রুজির প্রশ্ন। মেরেকেটে হপ্তায় হাজারখানেক কিলোমিটার তো কম সে কম চালাতেই হবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও ব্যথাকে এই মুহূর্তে গুরুত্ব দেওয়ার উপায় নেই।

বছর তিনেক আগে যখন প্রথম এই শহরে আসে পেনো, তখনও এখানে ব্যবসার সুযোগ কিছু কম ছিলো না। কিন্তু ওর কোম্পানি ছিলো ওর মতোই, শহরে নতুন, সঙ্গে নতুন প্রোডাক্টওর নিজের অভিজ্ঞতার অভাবটা আপ্রাণ পরিশ্রম আর জন্মগত উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে পুষিয়ে নিতো। মাস গেলে টার্গেট ছুঁতে পারতো প্রায় প্রতি মাসেই, তাই সব ওপরওয়ালা চুপ করে থাকতো। কিন্তু যে সব মাসে পারতো না, সে মাসে ওই লোকগুলোরই অন্য চেহারা দেখতো ও। প্রতি পদে ওকে মনে করিয়ে দেওয়া হতো- ওর লেখাপড়া কত কম, ও এখানে কতটা দাক্ষিণ্য পায়, মুদির দোকান খুললে কি ভালই না হতো- ইত্যাদি। সঙ্গে আরও যে সব কথা থাকতো, সে সব এখানে লিখতে পারা অসম্ভব। এক এক সময় মনে হতো, এরা বোধহয় চায়, আমি নিজেই চাকরিটা ছেড়ে দিই। দু’একবার সে কথা রাত জেগে ভাবেওনি, তা নয়। কিন্তু শেষ অবধি চাকরিটা ছাড়েনি পেনো।

মেস থেকে অফিস, অফিস থেকে ডাক্তারদের চেম্বার, সেখান থেকে কোম্পানির ডিপো, সেখান থেকে আবার অফিস। এর মাঝে কখনো কখনো বসের হুকুম হলে কোন কোন ফার্মাসিস্ট। মাস গেলে খাতা মেলানো, দোকানে দোকানে ঘোরা, দিন নেই-রাত নেই ডাক্তারদের তলবে থাকা- এমনকি একসময় একজনের বউ-ছেলেকে নিয়মিত বাজার বা কলেজ থেকে পিক-আপ অবধি করতে হয়েছে ওকে। যদিও তারপর দেখা গেছিলো, লোকটা ক্রমাগত প্রতিযোগী কোম্পানির ওষুধই লিখে গেছে এই গোটা সময় জুড়ে। কারণ ছিলো তার আগের মাসের সপরিবার ইউরোপ ট্রিপ। সৌজন্যে ওই @#৳% এর বাচ্চা প্রতিযোগী কোম্পানি। পুরো ঘটনা শুনেও মেজাজ হারাননি রিজিওনাল ম্যানেজার। ঠাণ্ডা মাথায় দেখা করেছিলেন ওই ডাক্তারের সঙ্গে। ডাক্তার টেবিলের ওপার থেকে মিষ্টি গলায় বলেছিলো- ‘আমার জানুয়ারিতে আফ্রিকান সাফারির একটা প্ল্যান আছে। ছেলের খুব ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির শখ। ক্যামেরাও কিনেছে।’ আর কিছু বলার প্রয়োজন হয়নি। টিকিট, হোটেল বুকিং এর কাগজপত্র বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসার পরদিন থেকে আশপাশের চারটে দোকান থেকে ওদের কোম্পানির সেল তিনগুণ হয়ে গেছিলো।

এই পুরো জাঁতাকলে ওর একমাত্র নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা ছিল ওর আগের কাজের শহরের মেস। যত ক্লান্তিই থাক, সপ্তাহান্তে বাইক চালিয়ে প্রায় একশো কিলোমিটার পেরিয়ে ও ঠিক পৌঁছে যেত ওখানে। এখনও সেই রুটিন সমানে চলছে। বাকিরা প্রত্যেকেই ওর মতোই এম.আর। দু’জন ওর সহকর্মী- তাদের মধ্যে একজন, বিজন, ওর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। ওর মতোই উপস্থিত বুদ্ধি, পরিশ্রমের ক্ষমতা আর প্রায় একইরকম পরিমাণে বিয়ার গিলতে পারে। ওরা না থাকলে ওর জীবনে সত্যি আর কিছু থাকতো না। বিয়ে-বউ-বাচ্চা- এ সবের কথা ভাবলেই ওর গায়ে জ্বর আসে। বিবাহিত লোকে কি আর এ জীবন কাটাতে পারে?

তিন বছর কম সময় নয়। এত রঙ্গ দেখে ফেলেছে ও জীবনের, এখনই রিটায়ার করতে পারলে অন্তত অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কিছু কম পড়তো না। এখন ও অনেক পাকাপোক্ত। প্রতিটি ডাক্তার ওকে নাম ধরে ডাকেন, চেনেন। দু’তিনজন তো কোম্পানির পার্টিতে ওর বসকে বলেওছেন- ‘আর কতদিন ছেলেটাকে দৌড় করাবেন- এবার প্রোমোশন দিন!’ ওর পাশের টেবিলে আসা সদ্য জয়েন করা ছেলেটা ওরই বয়সী, কিন্তু যখন ছড়িয়ে ফেলে, তখন ওকে ঝাড় দিয়ে নিজের টেবিলে ফিরে এসে অবাক হয়ে প্রণব বুঝতে পারে- ঠিক এই রকম ভাষাতেই ঝাড় খেয়ে কত রাত জেগে কাটিয়েছে ও নিজে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না, কিন্তু নিজেকে বলে- ‘ঠিকই আছে। হয় সহ্য না করতে পেরে চাকরি ছাড়বি, নইলে আরও ভাল কাজ করবি। পুরোটাই তোর ভালোর জন্য।’
আজ সকাল সকাল বেরোতে হচ্ছে, কাল অনেক রাত অবধি কাজ করার পরেও। কারণ- ওপরওয়ালার জরুরি তলব। গলার ধরণ শুনে মনে হয় খারাপ খবরই হবে। গত প্রায় দু’হপ্তা ধরে কানা-ঘুষো শোনা যাচ্ছে, যে ওদের রিজিয়ন ‘অ্যাচিভার’ হয়েছে বলে পুরষ্কার পাবে- ব্যাংককে তিনদিন ধরে পার্টি। তাই ভালো খবরই আশা করছিলো পেনো। কিন্তু ওরই তো কপাল- কত আর ভাল হবে?

অফিসে ঢোকামাত্র ওর জুনিয়র এসে খবর দিয়ে গেলো- ভালো খবরটা। গুজব সত্যি। পেনো, ওর বস আর রিজিওনাল ম্যানেজার তিনজন যাচ্ছে ব্যাংকক- পরের হপ্তায়। ও নিশ্চিত হয়ে গেলো- সক্কাল সক্কাল এটা শোনার পরেও যখন ওর তলব পড়েছে, তখন বসের কাছে ওর জন্য বেজায় খারাপ খবর অপেক্ষা করছে।

ঠিক তাই কি? বসের মুখে যা জানা গেল, তার মোদ্দা কথাটা গুছিয়ে বলতে গেলে কিছু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হবে।

ওদের কোম্পানির বৈশিষ্ট্য যে ওষুধ তৈরি- মানসিক অবসাদ কমানোর, সেটা প্রধানত প্রেস্ক্রাইব করেন এই অঞ্চলে মাত্র একজন ডাক্তার তিনি সাধারণত মাত্র দু’টি ওষুধ (ওই ধরনের) লিখে থাকেন। আর সে দু’টো দুই আলাদা কোম্পানির। একটা পেনোর, আর একটা ধরা যাক, ‘আপেল’ কোম্পানিরফলে, দুইয়েরই বিক্রি বেশ দুইচেটিয়া, ওই অঞ্চলে। এবার, গত মাস তিনেক ধরে দেখা যাচ্ছিলো, ওদের ব্র্যান্ডের বিক্রি তুলনায় হঠাৎ করে বেশ কমে গেছে। প্রথম প্রথম সেটাকে ডাক্তারের খামখেয়াল বলে ভাবা হয়েছিলো, সঙ্গে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছিলো কিভাবে আবার তাঁর প্রিয় হওয়া যায়, তার। কিন্তু হঠাৎ করেই গতমাসে এক নতুন, অন্যরকম তথ্য উদয় হলো। ওদের রিজিওনাল ম্যানেজার ওকে ডেকে বললেন, ‘আপেল’ এর সঙ্গে ওই ডাক্তারবাবুর বেশ খানিকটা মন কষাকষি হয়েছে। তার জেরে গত দু’মাস ধরেই তিনি ওদের ওষুধ লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে এখন তো সব প্রেস্ক্রিপশনেই পেনোদের কোম্পানির ওষুধ থাকার কথা! তাহলে? এমন নয় যে ডাক্তারের পসার কোনভাবেই কমে গেছে। সে রকম হলে খবর পাওয়া যেত। গল্প তাহলে নিশ্চয়ই কিছুটা অন্যরকম। ম্যানেজার পেনোকে দায়িত্ব দিলেন তদন্ত করার।

খবরটা শোনা মাত্র ওর মাথায় একটা অন্যরকম সন্দেহ দানা বেঁধেছিলো। তাই সেটাকেই প্রথম খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো। বহুদিন ধরে মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভদের সঙ্গে ওঠাবসা করে ও যতরকম অদ্ভুত ধরনের ঘটনার কথা শুনেছে, তার একটা হলো- ‘ভুতুড়ে টার্গেট’। ব্যাপারটা এই রকম- ধরা যাক, কোন একজন এম.আর (মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ) দেখলো, যে তার টার্গেট পূর্ণ করার সম্ভাবনা খুব কম। মাথায় বুদ্ধি থাকলে, সে তখন চেষ্টা করবে অন্য রিজিয়নের কোন ফার্মাসিস্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার। দোকানদারকে নিজের ভাগ থেকে কিছুটা প্রফিট দিয়ে রাজি করাবে যাতে সে ওই অঞ্চলের রিপ্রেসেন্টেটিভের থেকে ওষুধ না কিনে ওর কাছ থেকে কেনে। মানে কি দাঁড়ালো? একই কোম্পানির ওষুধ- নাকতলার ওষুধ চলে গেলো নাসিকে- নাকতলার এম.আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে মাসের শেষে কোটা পূর্ণ করলো আর নাসিকে তারই বেরাদরের চাকরি গেলো ওখানে বিক্রির হিসেব না দেখাতে পেরে। গোলমাল এখানেই শেষ নয়- কোম্পানি ভাবলো, নাকতলায় বোধহয় তাদের পসার খুব ভালোআর নাসিকে নিশ্চয়ই উলটো। তখন নাসিকের ডাক্তারদের তেলা মাথায় আরও তেল পড়লো, নাকতলার ডাক্তাররা কোম্পানি বেমালুম বাদ দিলেন। সর্বৈব ঘোটালা!

পেনোর ঘোরতর সন্দেহ হলো, নিশ্চয়ই এ ধরনেরই কিছু ঘটছে। প্রথমেই ও খবর নিলো ওদের অঞ্চলের ডিপোতে। ওষুধের ডেলিভারি ওখানেই হয়। কাগজপত্র ছাড়া ওখান থেকে কিছু বের করা সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, প্রতি মাসেই ওখানে একই পরিমাণে ওষুধ এসে পৌঁছেছে, আর পুরোটাই বেরিয়ে গেছে বাইরে। অথচ তার খুব সামান্য অংশের হিসেব মিলছে ওর শহরে। কোম্পানির প্রধান গুদামে কিন্তু হিসেব পুরো ঝকঝকে। এর পরের কাজ হলো ওই বিশেষ ডাক্তারের পেয়ারের ফার্মাসিস্টকে ধরা। সে সরাসরি অস্বীকার করলো প্রথমে। হাত দিয়ে দেখালো উপরে সাজানো ওষুধের তাক। সেখানে ঠিক ততটাই রয়েছে ওদের প্রোডাক্ট, যতটা পেনো নিজের হাতে আগের সপ্তাহে দিয়ে গেছে।


এর পর যা হলো, সেটা সিনেমার মতো। ওর সঙ্গে বাজে ভাটাতে ভাটাতে দোকানি যখনই অন্য খদ্দেরর ওষুধ আনতে ভিতরে গেছে- এক লাফে ভিতরে এসে কাউন্টারের নিচের বাক্স হাঁটকাতে শুরু করলো পেনো। এটা যে ওর পক্ষে কতটা ঝুঁকির কাজ, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। ওর আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হলে শুধু লজ্জাই নয়, চিরকালের মতো এখানে ব্যবসা বন্ধ। খবর ওপর তলায় পৌঁছলে চাকরিও যেতে পারে। তবু কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই কাজটা করে ফেলেছিলো পেনো। ফলাফল? হাতে নাতে। বাক্স ভর্তি ওদের ‘প্রোডাক্ট’। দগদগে সাক্ষ্য সেজে পড়ে আছে বাক্স-বন্দী হয়ে।

এর পরের ঘটনা ছোট। চাপের মুখে দোকানদার স্বীকার করলো যে অন্য অঞ্চলের এম.আর এর থেকে বেশি কমিশনে ওষুধ নিচ্ছে কে ডেলিভার করে জেনে তার নাম ডিপোতে দিতেই সব হড়হড় করে বেরিয়ে এলো। এর পরের কাজ ওর নয়। বিশাল কোম্পানির কোথায় কে ধান্দাবাজি করছে, সেটা জানার চেষ্টা ওর পে-স্কেলের ওপরে। নজিরবিহীন উদ্যোগের জন্য ধন্য ধন্য হলো ওর। কোম্পানি নিজের ফোকর ঢাকতে তদন্ত শুরু করলো। খবর রটলো, আসছে ব্যাংককের পার্টিতে ওর টিকিট বাঁধা। আজ সকালেই সেটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

খারাপ খবর নয়। ঠিক তার উলটো। খবর এসেছে, ওর কাজে কোম্পানি দারুণ খুশি। ওর পদোন্নতি হয়েছে। মাসের শেষে পকেট আর একটু মোটা, শারীরিক পরিশ্রম আর একটু কম আর মাথায় চাপ বেশ খানিকটা বাড়তে চলেছে। আজ পেনোর দিন।

আজ শনিবারও বটে। ব্যাঙ্ক থেকে গাদা গাদা টাকা একসঙ্গে তুলে ফেললো ও। ছ’প্যাকেট হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, ততটাই চিকেন চাঁপ আর এক গামলা গুলাব-জামুন তুলে গাড়িতে বেঁধে রওনা দিলো পেনো। বিয়ার ওখানে গিয়েই তুলবে। চিল্‌ড্‌ থাকা দরকার।

গুচ্ছের খাওয়া দাওয়া দেখেই পুরনো মেসের সকলে আন্দাজ করেছিলো। প্রচণ্ড গালাগালিও করছিলো ওর ন্যাকামি দেখে। তবুও পেনো কিছুতেই বলেনি আসল কারণটা কি। খাওয়ার শেষে প্রথম বিয়ারের ক্যানটা খুলে চিয়ার্স করে তবেই বললো ওর প্রোমোশনের খবর। সমবেত হো-হো চীৎকারের মধ্যে কান পাতা দায় হচ্ছিলো বটে, কিন্তু আজ অনেকদিন পর পেটের সাথে মনটাও ভরা ভরা লাগছিলো ওর। এই তো জীবন! এই মুহূর্তগুলোর জন্যেই তো বেঁচে থাকা! হুল্লোড় থিতিয়ে আসার পর সকলে চেপে ধরলো ওর এই হঠাৎ শিকে ছেঁড়ার রহস্য জানতে। বিনা বাক্যব্যয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করলো ওর নায়ক হওয়ার গল্প।

অনেকটা আনন্দ আর অল্প বিয়ারে বেশ খানিকটা নেশা হয়ে যাওয়ায় খেয়ালই করেনি পেনো বিজনের মুখটা। যখন খেয়াল করলো, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। সমস্ত ঘর চুপ। সব্বাই থমথমে মুখে বসে আছে। পেনোর হাত থেকে বিয়ারের ক্যানটা গড়িয়ে গিয়ে গোটা ঘর নোংরা করে ফেলেছে। তবু কারুর হুঁশ নেই। সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুখের হতভম্ব ভাবের সঙ্গে ঘৃণাও কি মিশে আছে কিছুটা? এ সব নিয়ে পেনো আরো কিছুটা ভাবতো হয়তো, কিন্তু ও তখন অবাক হয়ে দেখছিলো বিজনের হাতে ভাঙা কাচের বোতলটা ওর মুখের খুব কাছে বিপজ্জনকভাবে কাঁপছে, আর মুখের দু’পাশে সামান্য গ্যাঁজলা নিয়ে বিজন ওর বুকের ওপর চেপে বসে একনাগাড়ে বলে চলেছে, “আমার চাকরি খেয়ে তুই বিদেশ যাবি! অ্যাঁ! বিদেশ যাবি! প্রোমোশন মারাবি! অ্যাঁ! সমাজ উদ্ধার করছো শালা! আমার চাকরি খাবি! কেন বে, আর কেউ ছিলো না তোর গোয়েন্দাগিরি মারানোর জন্য! শালা কোম্পানির কুত্তা হয়েছো! আমার চাকরি খাবি শালা, অ্যাঁ......”

কি? গপ্পোটা মজার না?

No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P