Saturday, November 26, 2022

টুকরো-টাকরা

 ১)

রোজিদি কাজ করতো আমাদের বাড়ি। মুসলিম। ঘর ঝাঁট দিতো, মুছতো। রান্নাঘরে কিছু করতো না। ঠিকে কাজ করতো। মাটিতে বসে খেতো। আলাদা থালা-গ্লাস ছিলো। মা বলে দিয়েছিলো। 

রোজিদি ঘর ঝাঁট দেয়, ভাই রোজিদির পিঠে উঠে পড়ে। ঘোড়া-ঘোড়া খেলবে। গোটা মানুষ। ছোঁয়া-ছানি নেই। শুধু ঠাকুর-আসনের ধারেকাছে না।

আমি বুঝতাম না। অমন তো ছোটো থেকেই দেখছি। অমনই হয়। নিয়ম। 

বড় হয়ে বুঝলাম। আমরা — বিশেষ করে মা, প্রাচীনপন্থী ছিলেন। ছোঁয়াছানি মানতেন। ভাতের এঁটো মানতেন। আমি, বাবা, ভাই হাসাহাসি করতাম। বাঙালি এইজন্যেই এগোতে পারে না। কাঁকড়ার জাত বলে সবাই। হিন্দুকে মুসলিম টেনে ধরে, কায়েতকে বামুন, এসসি-কে ওবিসি। জাতপাতের ঊর্ধে উঠলেই মোক্ষ।

মহানন্দায় জল গড়ালো। আমি বড় হলাম, নাস্তিক হলাম। পড়ে, ভেবে, বুঝে। মানি না জাতপাত, ছোঁয়া-নাড়া — জাতের নামে বজ্জাতি সব। আমার সব খোলা মনের বন্ধু হলো। পরিচিতের সংখ্যা বাড়লো। সবাই, সব্বাই খুব পড়াশুনো করে, খুব প্রগতিশীল (কেউ কেউ ভেতর ভেতর আলাদারকম, পৈতে-টৈতে নিয়ে খুব হিট খায়)। কেউ কোনো জাতপাত মানে না। মানবধর্মে বিশ্বাস।

সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা।

সব্বাই কী সুন্দর সমান হয়ে যেত, বাঙালি কেমন জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিত — শুধু দেখুন, 

কোত্থেকে সব সেকু, মাকু, তিনু, চাড্ডি, নোভোট্টু, বুদ্ধিজীবি, তরমুজ, চটিচাটা — একগাদা এসে জুটেছে। এগুলো যে কেন একরকম হয়ে যায় না! তাহলেই তো বাঙালিকে আর কেউ আটকাতে পারতো না! একই বৃন্তে আমরা মালা হয়ে ঝুলতাম!

আমারও, কত্ত, কত্তগুলো বন্ধু থাকতো!

২)

আমি লজ্জিত, যে কলকাতা শহরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে উচ্চকিত না হলেও, যথেষ্ট গর্ববোধ করে - শেষে নীরদ সি-কেই সত্য প্রমাণিত করলাম।

সঙ্গের লেখার লেখকের ক্ষোভ যথাযথ। আমরা আত্মবিস্মৃত, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা বলে এইরকম!

লেখাটা (লিঙ্ক কমেন্টে) পড়ার পর ইন্টারনেট ঘাঁটতে বসলাম।

দিলীপ মহলানবিশের উইকির অবস্থা ( https://en.wikipedia.org/wiki/Dilip_Mahalanabis?wprov=sfla1 ) শোচনীয়। 

https://www.thebetterindia.com/.../forgotten-bengal.../ - এই লিঙ্কের লেখাটিতে বেশ কিছু নতুন তথ্য আর ছবি আছে। গুরুচন্ডা৯র লেখায় নাম নেই, এমন একজন - ডাক্তার হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির নামও জানলাম এর থেকেই, যিনি নাকি allegedly বর্ণ -বৈষম্যের শিকার ছিলেন। তাঁর উইকির অবস্থাও তথৈবচ। 

আরেকটি লেখা, দ্য প্রিন্টে বেরিয়েছে আগে -

https://theprint.in/.../when-celebrating-50-yrs.../611718/

শম্ভুনাথ দে-র উইকি বেটার। সেখানে নেই, এমন আর-একটা লিঙ্ক থাকলো NCBI-এর -

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3089041/

দ্য ওয়্যারের আর্টিকলটাও থাকুক এখানে-

https://m.thewire.in/.../remembering-sambhu-nath-de-the...

গুরু-তে এ নিয়ে আগের একটা লেখা- https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=19142


৩)

সরকারি কাজে হিন্দি ব্যবহার করতে হবে — এই দাবির ভালোমন্দ বিচার করতে গিয়ে আপনার মনে হতেই পারে, এ তো আসলে 'ইংরেজি-র বদলে' হিন্দির ব্যবহার — এতে আবার খারাপ কী হল?

খারাপ হত না, যদি উদ্দেশ্য সৎ হত। বহুভাষী এই দেশের প্রতিটি নাগরিক যাতে অন্তত দুটো ভাষায় সড়গড় (বাইলিঙ্গুয়াল) হন, সেই উদ্দেশ্যে কাজটা করা হত। সেক্ষেত্রে এই নির্দেশটি কেমন শোনাতো? 

অনেকটা এইরকম — "সরকারি কাজ, যে কোনো নাগরিক, তাঁর নিজের মাতৃভাষায় অথবা এই তিন/চার/পাঁচটি ভাষার মধ্যে যে কোনো একটিতে সম্পন্ন করতে পারবেন। যদি তাঁর মাতৃভাষায় উপযুক্ত লিপি না থাকে, অথবা সেই ভাষাটি এখনও সরকারি কাজে ব্যবহৃত হওয়ার স্বীকৃতি না পেয়ে থাকে, তবে অমুক নম্বরে অভিযোগ করুন.."

অর্থাৎ, মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার আর কোনো একটি 'সংযোগের ভাষা' বেছে নেওয়ার অধিকার সেই নাগরিকের থাকলো। 

এ না করে, 'সব কাজে হিন্দি ব্যবহার করো' বললে, তা, এক চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করতে আরেক চাপিয়ে দেওয়াই তো হয়, তাই না? এবার প্রশ্ন হল, তা কি এই নিয়মের প্রবক্তারা বোঝেন না? বোঝেন। কিন্তু ওই যে বললাম, তাঁদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। যে বিরক্তি আন্তর্জাতিক স্তরে ইংরেজির জন্যে বরাদ্দ রাখা যায়, সেটারই দেশি সংস্করণ যে হিন্দির জন্যেও রাখা প্রয়োজন, সেটা JNU তে ১৫-২০ দিনের যে কোনো কোর্স করলেই বোঝা যাবে। বোঝা যাবে, এই যে "ইংরেজির বিপরীতে হিন্দি রাখা হল" — এটা সম্পূর্ণ গো-বলয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। কারণ, একদিকে, তারা কনফারেন্সে 'Bilingualism' নামে কাঁদে (অর্থাৎ, প্রতিটি বক্তাকে ইংরেজি-হিন্দি দুই ভাষাতেই বলতে বলে), অন্যদিকে ২য় ভাষাটি হিন্দির বদলে কোনো প্রাদেশিক ভাষা হলে — বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের কোনো রাজ্যের হলে — দিশি রেসিজম লকলক করে ওঠে। তারা নিজেরা বক্তৃতা দেওয়ার সময়? 'হিন্দি-না-বোঝা' জনতার জন্যে এক লাইনও ইংরেজি বলে কি? না মশয়, বলে না। সাধারণ মানুষের কথা বলছি না — BHU-এর ফ্যাকাল্টির কথা হচ্ছে, JNU-এর বড়কর্তাদের কথা হচ্ছে। নীতি-প্রণয়ণে, হিন্দি আগ্রাসনে, NEP-র নামে গোবর-মাহাত্ম্য বিস্তারে যারা সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকে।

অতএব, এই ব্যাপারটি ঠিক 'ইঞ্জিরির বিরুদ্ধে' নয়, ওই আদ্যিকালের 'এক দেশ, এক ভাষা'-রই রকমফের — যার পক্ষে এককালে রবীন্দ্রনাথও সওয়াল করেছিলেন। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের বিশ্বজিৎ রায়ের একটি লেখার শুরুর কয়েক লাইন তুলে দিই— "এক ভাষা আর এক দেশের কথা বলে দেশকে হিন্দি-হিন্দুত্বের শিকড়ে আর ঐতিহ্যে ফেরানোর কথা বলছেন যাঁরা, তাঁরা আসলে জানেন না, এই এক ভাষা আর এক দেশের আদলটা আসলে বিলিতি। এই পোড়া দেশে আমরা কিছুই মনে রাখি না। পূর্বজরা হাত পুড়িয়ে যা শিখেছিলেন, আমরা তা ভুলে যাই, আবার ঘরে আগুন লাগাতে উদ্যত হই।..." এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিবর্তন নিয়ে জানতে চাইলে, আসল লেখার লিঙ্ক নীচে/কমেন্টে দেওয়া থাকলো।

এই সাম্প্রতিক হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখা একটি লেখায় একজন পরিচিত দেখলাম মন্তব্য করেছেন, ইংরেজি এতটাই বেশি বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে তার উল্টোদিকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রাখলেও ভালো লাগে। 

এই 'চটজলদি' প্রতিক্রিয়ার একটা ভয়ানক বদ ফলাফল আছে। একটা গল্প বলি এই প্রসঙ্গে (না বললেও আপনারা ভালোই বুঝতেন, নেহাত গল্পটা বলবোই বলে...)।

নিউজিল্যাণ্ডে আগে খরগোশ ছিল না। মানুষ সেখানে বাইরে থেকে বসতি স্থাপন করতে গিয়ে, মাংসের খোরাক হিসেবে, সঙ্গে করে খরগোশ নিয়ে যায়। মার্কেটে কোনো প্রাকৃতিক 'খরগোশ-শিকারি' না থাকায়, খরগোশেরা, ইয়ে মানে, খরগোশের মতো গতিতেই বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে। ইকোসিস্টেমের বারোটা বাজার আগেই এর একটা ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে, খরগোশের এক 'শিকারি', ফেরেট (বেজি-টাইপের) নামক আর এক রোমশ প্রাণীকে সেখানে নিয়ে আসা হয়। খরগোশের 'বিরুদ্ধে' আনা হলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, খরগোশ-শিকারে এই ফেরেটদের কোনো উৎসাহই নেই, বরং তারা নির্বিচারে আঞ্চলিক (এবং সংরক্ষিত) প্রাণী ধরে খেতে থাকে, কারণ তাদের অপেক্ষাকৃত সহজে শিকার করা যায়। বর্তমানে, খরগোশের সংখ্যা তো কমেইনি, ফেরেটরাও একই তীব্রতায় বংশবৃদ্ধি করেছে আর যে প্রাণীদের 'বাঁচানোর' কথা ভেবে ফেরেট আনা হয়েছিল, তারা বিলুপ্তপ্রায়। ফলত, নিউজিল্যান্ড সরকারের মাথায় হাত।

গল্পটি শিক্ষণীয় হোক, না হোক — আসল কথা হল,

যে কোনো ভাষার উলটোদিকেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রাখলে ভালো লাগে। সবারই। ইনক্লুসিভিটির পরিচায়ক তো। হিন্দি রাখলে ততটা লাগে না। কারণ, ক্ষতি আখেরে আমাদেরই।

হিন্দির এই আগ্রাসন যে আজকের নয়, সে কথা সকলেই জানে, তবে এই বছরের শুরুর দিকে এইবারের সাম্প্রতিকতম চেষ্টাটা শুরু হয়েছিল অমিত শাহ-এর হাতে। তার প্রতিক্রিয়ায় বেরোনো আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় থেকে এই উদ্ধৃতিটি দিয়ে ত্যানা প্যাঁচানো শেষ করি —

"ভাষা হিসাবে হিন্দি গুরুত্বহীন, এমন দাবি করার প্রশ্ন নেই। সেই ভাষার বিকাশ ঘটলেও তাতে কেউ আপত্তি জানাবেন না। কিন্তু, যে দেশ ঐতিহাসিক ভাবে বহুভাষী, তার উপর কোনও কৌশলেই হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি, পারস্পরিক সংযোগের ভাষা হিসাবে ব্যবহারের আপাত-নিরীহ পরামর্শের মাধ্যমেও নয়। দেশের মানুষ কোন ভাষায় কথা বলবেন, দুই ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন কোন ভাষায়— সেই সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই তাঁদের। তা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহের কর্তব্য ছিল এই বহুত্বকে সম্মান করা। তিনি বলেছেন, হিন্দি ভাষাকে নমনীয়, গ্রহণশীল হতে হবে— আঞ্চলিক ভাষার শব্দ গ্রহণ করতে হবে। ভাষা বস্তুটি সততই চলমান, জৈব। যে কোনও ভাষাই গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে— তার জন্য সরকারি ফরমানের প্রয়োজন পড়ে না। গ্রহণশীলতা অতি উত্তম ধর্ম— বিজেপির নেতারা বরং তা অভ্যাস করতে পারেন। তা হলে দেশের বহুত্বকে তাঁদের এতখানি অসহ্য ঠেকবে না।"


No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P