Wednesday, June 20, 2012

বুড়ো কুকুর

“...আমিও কেমন কুকুর হয়ে গেছি
চাটার আগে শুঁকে দেখছি তোমায়...” -- শ্রীজাত

স্বাগতা চা বা কফি খেয়ে আসার পর ওকে চুমু খেতে খুব ভালো লাগে অমিতের। স্বাগতা বলে flavored kiss। অল্প কিছু আশ্লেষ, তারপরেই খাট- খেলার মাঠ।

বর্ষা এসে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। পরিবেশ ঠাণ্ডা। সন্ধের পর থেকে মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। শহরতলী বলে এখনো পাঁচ-দশটা উভচর টিকে আছে। একে ঝির ঝির করে বৃষ্টি, তায় নতুন বাড়িতে পাতা আনকোরা সংসার। সন্ধের পর কোনদিনই ওদের বাড়িতে কেউ আসে না। রাতে স্বাগতা ঘুমোয় আর অমিত ইন্টারনেটে দেশোদ্ধার করে। তাই এইটাই ওদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার একমাত্র সময়।

আজ ব্যাপার আরও গুরুতর। বারোদিনের অন-সাইট ডিউটি শেষ করে আজ সকালেই বাড়ি ফিরেছে অমিত। যখন বাড়িতে ঢুকেছে, স্বাগতা তার আগেই ওদের এন.জি.ও র উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলো। ফিরেছে বিকেল ৩টে নাগাদ। ফলতঃ তার পর থেকে ঘনঘন নিজেদের মধ্যে আমিষ দৃষ্টি দেওয়া নেওয়া হচ্ছিলো। নেহাত কাজের মাসি ওই সময়েই আসে, তাই–

সাড়ে ছ’টায় দু’কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এলো যখন স্বাগতা, ততক্ষণে বাইরে ঝমঝম করে শুরু হয়ে গেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাওয়ার কাট আর মৃদু মোমবাতির মুখে আগুন। শুধু স্বাগতার চা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো অমিত। হওয়া মাত্র এক ফুঁয়ে নিভে গেলো মোম। ব্যাঙের ডাক, বৃষ্টির শব্দ- পাতায়, জানালায়, পাশের বাগানের টিনের চালে। প্রেম এলো সশব্দ চরণে। ছিলো না বলতে শুধু বেগম আখতারের কন্ঠে- ‘জোছনা করেছে আড়ি’।

ভালবাসার খরস্রোতা নদী হঠাৎই খাদের সামনে পড়ে জলপ্রপাত হলো ঠিক সাতটা দশে। সময়টা মনে থাকার কারণ, তখনই একটা বিদ্যুৎ ঝলকে ঘড়িটার দিকে চোখ পড়েছিলো অমিতের। অন্য যে কোন পুরুষের মতোই মিলনোত্তর আলিঙ্গন ব্যাপারটা অপ্রয়োজনীয় মনে হয় ওর। তবে আজ নিজে থেকেই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো। এমন সুন্দর হয়ে আছে চারপাশ, মনে শান্তি, বুকে আদুরে সঙ্গিনীর মাথা – আজই তো আলস্যের জয়গানের দিন।

সুরভিত নৈঃশব্দ খানখান হয়ে গেলো ইতরের বাচ্চা মোবাইলের কর্কশ আর্তনাদে। তীব্র বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে কোনরকমে উঠে ফোনটা তুললো স্বাগতা। ধরার আগে একবার অমিতের দিকে ঘুরিয়ে দেখালো, স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠেছে- ‘দিদা’।

বয়স আশির ঘরে চলে যাওয়ার পরে কি করে একজন মোবাইল ব্যবহারে পটু হয়ে উঠতে পারে, এ রহস্য অমিতের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। ওর কোন আত্মীয়-বন্ধুই পারেনি। মহিলা মহিয়সী – সন্দেহ নেই। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু সরকারি চাকুরের মেয়ে – পড়তি জমিদার বংশে বিয়ে হয়ে এ বঙ্গে যখন এসে পড়েন, তখনো ইংরেজ আমল শেষ হয়নি দেশে। স্বামী যক্ষ্মার রুগি – সে তথ্য গোপন রেখেই বিয়ে হয়েছিলো। তিনি ইহজগৎ থেকে কেটে পড়ার সময় গুচ্ছের দেনার সঙ্গে রেখে গেলেন চার দামড়া ছেলেমেয়ে – যাদের দৈনিক খোরাকি পূর্ণবয়স্ক লোকের মতো হলেও অর্থোপার্জনের যোগ্যতা কারুরই হয়নি। সেই অবস্থা থেকেই সেলাই করে আর নার্সারি ইশকুলে পড়িয়ে সংসার চালিয়েছেন যোগমায়া।

এখন বানের মুখে কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ান এ সন্তান থেকে ও সন্তানের বাড়িতে। অমিত বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, তায় বাড়ির বাইরে থাকে বিয়ে করে। তাই ওদের বাড়িতেই দিদার অধিকাংশ সময়ের আস্তানা। কিন্তু এক বাড়িতে থাকলে কি হবে- বুড়ি চরে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে। গত বছর কাউকে না বলে হঠাৎ করে পাড়ার দলের সঙ্গে মিলে কেদার-বদ্রী ঘুরতে চলে গেছিলো। একটু কুঁজো, কিন্তু এখনো বিরাট দম।

এককালে এই দিদাই ওকে মানুষ করেছে। মা- বাবা দু’জনেই চাকরি করতো। স্কুল থেকে ফিরে এই মহিলার মুখ প্রথম দেখতে পেতো অমিত। খেতে দিতো, ঘুম পাড়াতো দিদা ই। প্রথম প্রেমের গল্প পড়া দিদার আলমারি থেকে চুরি করেই। প্রথম ব্যোমকেশও। প্রথম রথ দেখা, প্রথম পয়সা চুরি- প্রথম অনেক কিছুরই দিদা সাক্ষী। তারপর অমিত বড় হয়ে গেছে- কিন্তু সেটা বুঝে ওঠার আগেই দিদা বুড়িয়ে গেছে। কানে খুব কম শোনে- তাই ফোনে কথা বলা একরকমের যন্ত্রণা। কি বলেছে মনে থাকেনা, তাই বার বার করে এক কথা বলে। কিন্তু সে কথা ধরিয়ে দিলে ঝিকির দিয়ে ওঠে- “আমার মনে থাকে না! প্রতি হপ্তায় তোদের মনে করে ফোন দেয় কে র‍্যা! বাড়ি এলে দিদার সঙ্গে দেখা করার কথা কার মনে থাকে না?” অমিত আর বলতে সাহস পায় না, যে মনে থাকলেও যাওয়া হবে না, কারণ, বেজায় সময় নষ্ট। উপরের ঘরের কম ভোল্টেজের আলোয় বসে বুড়ির বকবকানি শুনতে শুনতে যে একটু গল্পের বইও পড়বে, তার যো নেই। তার ওপর এখন বিয়ের পরে তো আত্মীয়ের সংখ্যা ভীতিপ্রদ ভাবে বেড়ে গেছে। তাদের সময় দেওয়া- পুরনো আড্ডার ঠেকে গিয়ে স্মৃতিচারণ, নদীর পাড়ে বউকে সময় দেওয়া, বাবা-মা কে সময় দেওয়া- ছুটি গুলো কখন যে ফুস্‌ করে উড়ে যায়, বোঝাও যায় না।

দেখা না করলে কি হবে? বুড়ি প্রতি হপ্তায় দু’একবার করে খোঁজ নেয় স্বাগতা-অমিতের। সারা দিন পরে কখনোই গলাবাজি করতে ইচ্ছে করেনা বলে প্রতিবারই ফোনটা প্রথমে স্বাগতা ধরে। খবরাখবর জানিয়ে অমিতের হাতে দেয় আর কোনক্রমে কুশল বিনিময়ের পরে মুক্ত হয় ও। আজও নিশ্চয়ই বুড়ির সেই রকমই কোন ধান্দা ছিলো। কিন্তু আজকের দিনটা ঠিক অন্য দিনগুলোর মতো নয়। আজ ওদের দু’জনের দিন। অনেক দিন পরে পাওয়া সুযোগ। হাতে বেশি সময়ও নেই। রাতে বিদিশা- সুজয় কে খেতে বলা আছে, ওরা আর হয়তো আধ ঘন্টার মধ্যেই এসে পড়বে।

হয়তো সেই কারণেই আজ স্বাগতা একটু কম কথাই বললো- একটু ঠাণ্ডা গলাতেই যেন। অমিত কে ফোনটা দিতে এলে ও ইশারা করলো যে ও বাড়িতে নেই। স্বাগতা একবার চোখ পাকিয়ে ফোনে বললো, “ও ঘুমিয়ে পড়েছে দিদা, কাল কথা বলবেন, কেমন?”

ফোনটা রেখে দেওয়া আর বিদিশাদের আসার মাঝে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ফারাক ছিলো। তবু সেই মুডটা আর ছিলো না ওদের। কেমন খিঁচড়ে গেছিলো।

রাতে খেতে বসে গল্প হচ্ছিলো বিদিশাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে। বাড়িতে সুজয়ের বাবা থাকেন। বিপত্নীক। বিদিশাটা চিরকালই একটু মুখফোড়- “বিশ্বাস করবি না, আমি এখন ফাঁকা জঙ্গলে সুজয়ের সঙ্গে একলা হলেও গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোবে না- মুখ চেপে চেপে এমন অব্যেস হয়েছে...!” সুজয় মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো। কথা বলেনি।

হঠাৎ করে চিকেনটা বিস্বাদ লাগতে শুরু করে অমিতের। কাউকে কিছু বলেনি। থমকে বসে ভাবছিলো, ছোটবেলায় মার কাছে শোনা গল্প- একদিন বাড়িওয়ালা নিচে এসে ঝাড় দিয়েছিলো বাবাকে। উনুনের ধোঁয়া দোতলা অবধি উঠে যাচ্ছে বলে। বাবা কিচ্ছু বলেনি। শুধু দুপুরে অফিস ফেরত প্রায় সবটুকু সঞ্চয় ভাঙিয়ে সন্ধেবেলা গ্যাস ওভেন আর একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড সিলিন্ডার নিয়ে এসেছিলো। সেদিনই নাকি মা প্রথম প্রেমে পড়ে বাবার। সেদিনও কি এইরকমই ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো? সেদিনও কি মা গরমে ঘেমে বাবাকে গ্যাসের ওভেনে মাংস রান্না করে খাইয়েছিলো? রুগ্ন শরীরের দাদু নাকি রাশভারী বাপের সামনে নতুন বৌ দিদাকে প্রেমের কথা বলতেই পারতো না। চিঠি লিখতো। সেটা আবার সাহস করে এসে দিদাকে দিয়েও যেতে পারতো না। একদিন ঘর গোছাতে গিয়ে দিদা সেগুলো খুঁজে পায়। সেদিন শুরু হয় আরেকটা প্রাচীন প্রেমের। সেদিনও কি সন্ধেবেলা আলো ছিলো না, মোমবাতি জ্বলছিলো?

অতিথিরা চলে যাওয়ার অনেক পরে, রাতে বিছানায় ঘুমিয়েছিলো স্বাগতা। অমিত ওর মুখের খুব কাছে গিয়ে পাগলের মতো খুঁজছিলো সম্ভাব্য বলিরেখার চিহ্ন। হয়তো ওর নিঃশ্বাসেই, স্বাগতা একবার ঘোলাটে চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলো, “কি গো? শুঁকছো কেন?”

3 comments:

Give me your thoughts, I will give you replies. :P