Wednesday, June 6, 2012

ঠাণ্ডা- লাভা

1

স্ট্রবেরী ওয়াইল্ড অর্থাৎ বুনো হলে তার স্বাদ বেড়ে যায় কে জানতো? বিশেষ করে তা যখন পাওয়া যায় এমন এক রাস্তার ধারে, যা বরাবর চলতে চলতে মাঝে মধ্যেই মনে নিকো পার্কের বাচ্চা রোলার-কোস্টারের কথা উঁকি দিয়ে যায়? হলুদ রঙের এবড়ো খেবড়ো ওই ফলগুলোকে স্ট্রবেরী বলে মানতে বেজায় আপত্তি থাকলেও মুশকো জোয়ান ড্রাইভার (যার হাতে প্রাণের জিম্মা দিয়ে চলেছি পাঁচ ভেতো বাঙালি) জোর দিয়ে বললো যখন- আপত্তি করে কার বাপের সাধ্যি? পরে দেশে ফিরে দেখি ওগুলোকে সত্যিই ভারতীয় স্ট্রবেরী (Mock Strawberry) বলে- এই দেখুন। তবে গল্পটায় অনেক এগিয়ে গেছি, তার আগের কিছু ঘটনা না বলে নিলে আপনারা থই পাবেন না।

মাত্র দু’দিনের তোড়জোড়ে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চাট্টি অরুণ এবং একজন কিরণমালা। লক্ষ্য- কলকাতার প্লাস্টিক ব্যাগটা থেকে বেরিয়ে একটু দম নিয়ে আসা- সম্ভব হলে ঠাণ্ডা কোথাও। কিভাবে কি করেছি, তার বিবরণ পরেই দেবো’খন (আপনাদের সুবিধের জন্যেই), আপাতত ধরে নিন, দুম করে আমরা এসে পড়লাম সেবক ব্রিজের ধারের এক সরাইখানায় (সেখানে অবশ্যি থাকতে দেয়না, কিন্তু সরাইখানা বললে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ আসেনা?)- দু’প্লেট লাল রঙের অতি সুস্বাদু ছোলা বাটোরা আর দু’প্লেট তড়কা-রুটি গোগ্রাসে গিলতে। সঙ্গের ড্রাইভার সেয়ানা লোক, মাঝেমধ্যেই “বুzলেন তো, বুzলেন তো” বলে অনেক কিছু জপানোর চেষ্টা করছে আর আমি সামনে বসে থাকায় সে সবের উত্তরও দিতে হচ্ছে আমাকেই। শেষ অবধি আর উপায় না দেখে ওর কোন কথায় কান না দিয়েই আমি “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথা” বলতে শুরু করেছিলাম।

গাড়ি চললো সেবক ছাড়িয়ে বহুদূর- মাঝে পড়লো অনেক চা-বাগান, যার একটারই নাম আমার পরিচিত- Goodricke- সে যাকগে, গরুবাথান পেরোলাম যখন, (আগেও ওই রাস্তায় একবার গেছি, আর তখন ওখানে জায়গায় জায়গায় টাঙানো ‘Welcome to Gorkhaland’ পোস্টার দেখে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়েছিল, নইলে কোন একটা জায়গার নাম আমি মনে রেখেছি- এ আমার শত্তুরেও বিশ্বাস করবে না) মনে আশা জাগলো, এইবার হয়তো গরমটা একটু হলেও কম লাগবে। হলোও তাই- সর্পিল রাস্তা দিয়ে গাড়ি যতই ওঠে, দূরে পাহাড়ের গায়ের মেঘগুলো ততই আরও কাছে আসতে শুরু করলো। একসময় দেখা গেলো আমাদের চারদিকে মেঘ আর মুখভরা হাসি। সেই যে তখন শুরু হলো “শালা এখানেই থেকে যাবো” বলা, সেটা একেবারে ফিরে আসার সময়েও থামেনি। লাভায় আমাদের বুকিং ছিলো Orchid হোটেলে। টাউনের মাঝখানে, একটা ভীষণরকম চড়াইয়ের শেষে, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের একদম গায়ে। দুনিয়ায় চিরকাল যা হয়ে এসেছে, তাই হলো। কমদামী ঘরটায় পাওয়া গেলো বিশাল ব্যাল্কনি, যা দিয়ে মেঘের রাজ্য দেখা যায়(পরে আমাদের ঘরেও মেঘ ঢুকে পড়েছিলো) আর বেশি দামের ঘরটার বেশি দামের কারণ হলো একখান বস্তাপচা টিভি, যেটা একবারও অন করা হয়নি। তবে সবাই ঘুমোতে যাওয়ার সময়টুকু ছাড়া নিচের তলার ব্যাল্কনিতেই কাটিয়েছিলাম বলে আলাদা কিছু বোঝা যায়নি। বিকেল করে পৌঁছেছিলাম বলে কোথাও না গিয়ে লাভা পায়ে হেঁটে ঘোরা মনস্থ করলাম। সে কি জায়গা, কি বলবো মশাই, বাচ্চাগুলো থেকে শুরু করে কুকুরগুলোর পর্যন্ত বেজায় দেমাক, কিন্তু বড্ড শান্ত। আমরা সক্কলে জানি পাহাড়ের মানুষ খুব পরিশ্রমী হয়- কিন্তু ঠিক কতটা, নিজের চোখে না দেখলে মোটেই মনে থাকেনা- যতবার দেখি, তত ভুলে যাই। আমরা ঘুরে বেড়ালাম অন্ধকার নামা অবধি- চড়াই-উতরাই বেয়ে, জোঁকের ভয় এড়িয়ে, বিজাতীয় গরু আর ফুলো ফুলো কুকুরের পালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। খাওয়ার পরের সিগ্রেটের মতো করে টান দিলাম অক্সিজেনের ভাগ কম পড়া বাতাসে, ন্যাড়া টিলায় দাঁড়িয়ে গলা খুলে চিৎকার করলাম পাহাড়ি টারজানের মতো, ঝাউবনের canopy দেখে আহ্লাদ করলাম আর মনকে বারে বারে ধমকে ভুলিয়ে রাখলাম যে দুদিন পরেই এখান থেকে চলে যেতে হবে।

পরদিন সকালে আমার মতো লেট-লতিফও উঠে পড়লাম সকাল সাড়ে পাঁচটায়, ভাবা যায়! ঘুম থেকে উঠে স্নান করে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে, ক্যামেরা বগলদাবা করে আমরা, পাঁড় কলকাত্তাইয়ারা সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়েছি হাঁটতে, ভাবতে পারেন? আমরা যাবো লাভা থেকে রিশপ, পায়ে হেঁটে- ফিরবোও সেভাবেই। দলের কিরণমালা আগের দিন থেকেই গাঁইগুঁই শুরু করেছিলো হেঁটে যেতে পারবে না, জোঁক ধরবে- এইসব নানা বাহানা করে। তাকে ফেলে চলে আসার হুমকি দেওয়ায় গোমড়া মুখেও সে যেতে রাজি হয়েছে। আমাদের গাইডের নাম রমেশ। কতক্ষণের রাস্তা জিজ্ঞেস করায় সে অবজ্ঞার হাসি হেসে বললো- আমাদের জন্যে কম সে কম একঘণ্টা, যদিও তারা ওই রাস্তা আধঘণ্টায় পৌঁছে যায়। বীর-দর্পে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা ক’জন।

মাত্র মিনিট-খানেকের মধ্যে আমাদের জিভ বেরিয়ে বুকে। কি রাস্তা! খাড়া উঠে গেছে শোঁ শোঁ করে। তার ওপরে আমাদের জানা নেই আর ঠিক কতক্ষণ চলবে এই চড়াই, তাই মুখে কিছু না বললেও আমি তো বেশ ঘাবড়েই গেলাম- এই ঘটোৎকচের মতো চেহারায় চলতে চলতে ফুসফুস আবার হাপর না হয়ে যায়। কখনো জঙ্গুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে, কখনো ছাগল-চরা পথে হাঁটতে গিয়ে একবারও যে উল্টোদিকে যাওয়ার কথা ভাবিনি তার কারণ- অসাধারণ সৌন্দর্য! দু’পাশে নেমে গেছে খাদ, একদিকে অনেক নিচে পিচের রাস্তা, অন্যদিকে অতল বুনো গহ্বর। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য রমেশের অভয়বাণী সত্য প্রমাণ করে আমরা বেশ কিছুটা ভালো রাস্তায় উঠে এলাম। সে রাস্তার সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো শব্দ বা বাক্য আমার শহুরে কি-বোর্ডে নেই। অরুণ নম্বর ১ এর কথা ধার করে বলতে হয়- “বিভূতি পাতার পর পাতা কেন যে লিখেছিল বুঝতে পারছি মাইরি...”। দু’জন পাতলা সদস্য আর দলের মেয়েটি জোর কদমে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে চলে গেছে- পিছনে পড়ে আছি দুই ক্যামেরা-বাহক অপোগণ্ড। এদিক ওদিক তাক করে করা shutterbug এর খচর খচর মিশে যাচ্ছে অজস্র পোকা আর পাখির ডাকের সাথে। কখনো ওই রাস্তা দিয়ে উঠে আসছে একপাল গরু নিয়ে সুন্দরী দু’টি মেয়ে (যাই বলুন, অমন জায়গায় সক্কলকে সুন্দর দেখায়), কখনো রিশপে বেড়াতে আসা, গামবুট পরিহিত স্বামী-স্ত্রী, যাদের দেখে মনে আশা জাগে, এরা যখন পারছে, আমিও পারবো পুরো রাস্তা যেতে-আসতে।

রিশপে পৌঁছে আমরা গিয়ে বসলাম নেওড়া ভ্যালী রিসর্টের ক্যাম্পাসে। ঢালু পাহাড়ের গায়ে ফুটে আছে যত্নে সাজানো ফুল আর ততোধিক যত্নে সাজানো ছোট্ট ছোট্ট কটেজ। চারপাশে নানা বয়সের, নানা চেহারার কুকুর- কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ পাশে এসে বসে আছে- ভাবটি যেন মোটেই পাত্তা দেয়না আমাদের, কিন্তু বিস্কিটের প্যাকেট বের করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে চলে আসবে কাছে। একটা কালো আর দুটো তামাটে কুকুর এর পর সারা রাস্তা (রিশপ থেকে লাভা) এসেছিলো আমাদের সাথে।

ফিরতি পথে এক মজার কাণ্ড। যখন প্রায় লাভা পৌঁছে গেছি, বেশ কয়েকবার জিরিয়ে নেওয়ার পরে- মানে সেই সরু ছাগল-চরা বুনো রাস্তাটা বেয়ে এখন নামার পালা, তখন আমাদের পায়ে পায়ে চলা কুকুরগুলো হঠাৎ করে বেদম ডাকতে শুরু করলো। তখন আমরা নামছি এমন একটা সিঁড়ি বেয়ে, যার ধাপগুলো তৈরি হয়েছে কোন এক গাছের শিকড় মাটি ঘিরে ধরার ফলে। দু’পাশে একটুও জায়গা নেই সরে যাওয়ার। এমতাবস্থায় পিছন থেকে ধুপধুপ শব্দ আর টুং টুং ঘণ্টির আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একপাল ছাগল সেই ঢাল বেয়ে বিপজ্জনক গতিতে নেমে আসছে আমাদের দিকে। আমরা যখন প্রমাদ গোনায় ব্যস্ত, তখন আমাদের পিছন থেকে কালো রঙের দলের পাণ্ডা কুকুরটা, যেটা প্রচুর ভাব দেখিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলো, ডাকতে ডাকতে চলে এলো আমাদের সামনে। এমন ভাবে ঘিরে ধরলো রাস্তাটা, যে ছাগলগুলোর আর এগনোর পথ রইলো না সামনে। ওরা কতকটা বাধ্য হয়েই নেমে গেলো পাশের ঢাল বেয়ে, যেখান দিয়ে মানুষের পক্ষে নামা অসম্ভব না হলেও বেদম কঠিন কাজ। এরপর সেই সারমেয়-প্রধান আবার একই র‍্যালা নিয়ে এগোতে শুরু করলেন আমাদের সামনে সামনে। লাভা পৌঁছে আমরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছি, তখন ও আমাদের পাশেই বসে ঝিমোচ্ছিলো। বিস্কিট খেতে দিলাম, একবার শুঁকেই মাথা ঘুরিয়ে নিলো। আমার ব্যাখ্যা ছিলো, ও বলতে চাইছে, ‘এসেছি লোক পছন্দ হয়েছে বলে, এর মধ্যে আবার দেনা-পাওনা কিসের বাপু?’ আমার গিন্নির বক্তব্য, ‘বিস্কিটে ক্রিম ছিলো, তাই খায়নি, জানে লোম পড়ে যাবে’।

কে জানে, আমার কিন্তু নিজের ধারণাটাই ঠিক মনে হচ্ছে।

2

লাভা-রিশপ-লাভা – এই শাটলকক অভিযানের শেষে আমরা যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন পাহাড়ি সূর্য মাথার ওপর উঠে গেছে। হাতে অনেক সময়, আমরা রাস্তাতেই ঠিক করে নিয়েছি, যে তড়িঘড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়বো ছাঙ্গে জলপ্রপাত দেখতে। যেতে আসতে বলছে ঘণ্টা দেড়েক করে সময় লাগবে, রাস্তা খারাপ, তাই আশা করা যায়, বিকেলের মধ্যে ঘুরে আসতে পারবো। পরিকল্পনা যেমন ছিলো, আশ্চর্যজনক ভাবে দলের সকলে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও, দিব্যি সেই রকমই হলো! মনে হয় বাঙালি বেড়াতে গেলে নিজেকে সায়েব মনে করে। সে যাই হোক, খেয়ে দেয়ে পাঁচ-মূর্তি তো বেরিয়ে পড়লাম একটা জিপে করে, বেশ স্বাস্থ্যবান এক ড্রাইভারের ভরসায় জীবন দিয়ে (ভাবছেন বাড়াবাড়ি বলছি? একবার ওই রাস্তায় বর্ষাকালে গিয়ে দেখবেন- প্রাণ যদি নিয়মিত সময়ান্তরে গলার কাছে উঠে না আসে- গোলবাড়িতে একদিন মাংস খাওয়াবো), খাওয়ার পরের আর সারা সকালের অনভ্যস্ত খাটনির পরে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসিদের প্রবল হাতছানি অগ্রাহ্য করে। আগের দিন যে রাস্তায় আমরা হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, সেই রাস্তা বরাবরই চললো গাড়ি- পার্থক্য শুধু কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তার চেহারা এমন দাঁড়ালো, আমি কল্পনা করলাম, এখান দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে Westeros এর Giant বাহী বিশালকায় ম্যামথ। সে কি রাস্তা! সরু, এবড়োখেবড়ো, গোদা গোদা পাথর ছড়ানো আছে ইতস্তত, কোথাও বেশ খানিকটা জলের নিচে রাস্তা কোথায় বোঝা যাচ্ছে না- এর সঙ্গে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো আছে হঠাৎ করে উলটো দিক থেকে এসে পড়া একটা করে বড়সড় গাড়ি, বলাই বাহুল্য সব ক’টাই আসছে ছাঙ্গে থেকে। কোন একটা গাড়ি তখন থেমে যাচ্ছে, অন্যটাকে যাওয়ার রাস্তা করে দেওয়ার জন্য। এ সবের মধ্যেও আমাদের অফুরন্ত এনার্জি। একজন বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণ করা শুরু করলো- “বলতো, এই যে গাড়ি গুলোর নাম জিপ, সেটা কেন হলো?” নিরুত্তর শ্রোতাদের থেকে উত্তরের আশা নেই বুঝে জানিয়ে দিলো- “এগুলো আসলে GPV- General purpose vehicle. আচ্ছা, এবার বলতো, এগুলোর সঙ্গে এমনি গাড়িগুলোর পার্থক্য কোথায়...?” বুঝতেই পারছেন, এইরকম অজস্র প্রশ্নের আর কোনটাই আমার মনে নেই। বিশাল দীর্ঘ রাস্তার প্রায় পুরোটা জুড়েই একদিকে খাদ, অন্যদিকে খাড়া, ন্যাড়া পাথর। কখনো তার সাথে জুড়ছে বিশাল সব ঝাউ গাছের সারি, কখনো কুয়াশা-ঢাকা পাহাড়ের পরিচিত অথচ কখনো পুরনো না হওয়া ছবি। সমস্ত পথ ধরেই আমরা নিচে নামছিলাম। এতটাই ঢাল, অধিকাংশ সময় ড্রাইভার ইঞ্জিন বন্ধ করে রেখেছিলেন। হঠাৎ করে একটা বাঁকে গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হলো। কারণ বুঝতে না পেরে আমরা ইতিউতি দেখছি- মনে হচ্ছে এখান থেকেই হয়তো ছাঙ্গে অবধি হেঁটে যেতে হবে, এদিকে ড্রাইভার হাঁটা লাগিয়েছেন সোজা রাস্তার ধারের ঝোপের ভিতরে। মনে মনে ভাবতে শুরু করেছি- “ব্যাটা রওনা হওয়ার আগে প্রাতঃকৃত্য সারতে পারলো না?”- তখনই দেখি একগাল হাসি আর হাতে কয়েকটা বুনো লাল-হলুদ ফল নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন ভদ্রলোক। এগুলোই সেই বুনো স্ট্রবেরি, যেগুলোর কথা আগের দিন বলেছিলাম আপনাদের। এই স্ট্রবেরি পর্বের শেষেই আমরা ছাঙ্গে পৌঁছে গেলাম ভাববেন না- রাস্তায় একবার টায়ার পাংচার হলো। চাকা সারানোর ফাঁকে আমরা ক্যামেরা-বাহীরা ও এক অত্যুৎসাহী পাশের বুনো ফুলের জঙ্গল ধরে খাড়া কিছুটা উপরে উঠে প্রবল হাওয়ার তোড়ে কিছুক্ষণ আরাম নিলাম, আর দারুণ দেখতে একটা রাস্তার কিছু ছবি তুললাম।

নাহ্‌, ভয় নেই। শেষ অবধি পৌঁছলাম ছাঙ্গের কাছে। ঠিক করে বলতে গেলে, উপরে। অনেকটা বাঁধানো পথ ধরে নেমে যেতে হবে নিচে, জলপ্রপাতের তলায়। হাঁটা শুরু হলো। অদ্ভুত হাঁটা। মনে রাখতে হবে, শহুরে, ভেতো, আর কায়িক পরিশ্রমে অনভ্যস্ত এই ছেলে-মেয়েগুলো সারা সকাল ৮ কিলোমিটার হেঁটেছে দুর্গম চড়াই উৎরাই বেয়ে। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। প্রতিটি পদক্ষেপে হাঁটুর কাছে কড়কড় করছে- শোষিত মালাইচাকির শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! দু’জন ওই রাস্তাতেই মিলখা সিং হয়ে গেলো- দৌড়লে নাকি ব্যথা কম লাগছে! কি জানি বাবা, আমার তো হাঁটতেই দম বেরোচ্ছিলো, দৌড়লে আর দেখতে হতো না! বাঁধানো ঢালু রাস্তায় মাঝেমধ্যেই সিমেন্টের বিশ্রাম-ছাউনি। তখন বুঝিনি, পরে ওঠার সময় তাদের মর্ম হৃদয়ঙ্গম হলো। যাই হোক, নিচের দিকে যেতে যেতেই দেখা যাচ্ছিলো জলপ্রপাত। ‘নিচে’ বলে কিন্তু ভুলেও মাটির কাছাকাছি ভাববেন না। জলপ্রপাতের যেখানে শেষ, সেখানে সিমেন্ট দিয়ে ঘিরে কিছু জায়গা বানানো হয়েছে ভ্রমণবিলাসীদের জন্য। আর পাথর ফেলে এমন ভাবে ঘেরা হয়েছে, যাতে তলার pool টা শান্ত থাকে প্রায়। কিন্তু, এর পরেও জল গড়িয়ে গেছে অনেকটা নিচে, হারিয়ে গেছে একটা ‘অতল’ গুহায়। তারপরেও পাহাড় নেমে গেছে-যদ্দূর চোখ যায় না, তদ্দূর। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এ জায়গার সৌন্দর্য আপনার চেনা জলপ্রপাতের মতো নয়। বেশি কথা বলতে পারছি না, গিয়ে দেখে নিন। আমরা ওখানে ছিলাম অনেকক্ষণ- প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। প্রথমদিকে যে দু’জন পৌঁছেছিলো, তারা নাকি রঙধনুও দেখতে পেয়েছিলো। সে আর কি করা যাবে- ওদের কাছে তো আর ক্যামেরা ছিলো না J। অনেকক্ষণ বসে থেকে, পিছল পাথরে দাপাদাপি করতে গিয়ে পিছলে জলে পড়ে গিয়ে (যারা দেখেছিলো, তারা কেউ রেকর্ড করেনি... হুঁহ্‌), ছিটে জলে ক্লান্তি ভুলিয়ে, অতল খাদে উঁকি মেরে, এখান থেকে বেস জাম্প করা যায় কিনা- সেই নিয়ে খানিক বাজে বকার মাঝেই অনেক অন্য লোকের ভিড় জমে গেলো। আলোও পড়ে আসছিলো। আমরা উঠে আসা মনস্থ করলাম। ফেরা নিয়ে আমি একটাই কথা বলবো- আর সেটা সব জলপ্রপাতের জন্যেই সত্য- যদি উঠে আসার দম না থাকে, ভুলেও নিচে নামার কথা ভাববেন না। নিচে থেকে গেলে খাবেন কি? আমরা যথেষ্ট তাড়াতাড়িই উঠে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সৌভাগ্য সকলের নয়। আমাদের সঙ্গেই আসছিলেন একটি বাঙালি পরিবার। স্বাস্থ্যবান স্বামী, ইতিমধ্যেই কোমরে বাত ধরে যাওয়া, হাতে লাঠি স্ত্রী আর এক বছর ছয়-সাতের বাচ্চা ছেলে। মাকে সঙ্গ দিতে বাবা পিছিয়ে পড়েছে, মা ক্রমাগত গজগজ করে চলেছে, সে আর কি করে, এগিয়ে গেছে একটু। রেলিঙের ধার থেকে বাবা-মাকে ডেকে বলছে তাড়াতাড়ি আসার কথা। তা, তেনারা এসেই প্রথমে যা করলেন, সেটা হলো বাচ্চাকে ভয়ানক কড়কানি। হাতে দু-একটা চড়-চাপড়ও হলো। আমি দেখেও না দেখার ভান করছি। কিরণমালা অত সাবধান মানে না। জোরে জোরে বলতে শুরু করেছে, (অবশ্যই আমাকে উদ্দেশ্য করে)- ‘ও, অন্যের ছেলেকে বকলে Child Abuse, আর নিজের হলেই পেটানো যায় ইচ্ছেমত?’ একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে খাদ- আমি কোথায় লুকোই বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার বুঝছিও না, এই ঝাঁঝের কারণ কি- ইস্কুলে বহুদিন পড়ানোর ফল, নাকি সদ্য কোন এক খানের টিভি শোয়ের এপিসোড। সে যাই হোক, সেই বিশ্রাম ঘরগুলো পুরোদস্তুর ব্যবহার করে উপরে উঠে এলাম আমরা। সেই বাঙালি গিন্নি তখনো বকে চলেছেন- ‘...বাবাহ্‌ আর এট্টুখানি তাহলেই পৌঁছে যাবো কি কুক্ষণে যে এসে পড়েছিলাম এই রাস্তায় কেউ নামে এই বুটুন ওদিকে যাস না বাবা সোনা আমার কি থেকে কি হয়ে যাবে এই তুই আর রাস্তা ঘিরে দাঁড়াস না নিজেই উঠতে পারছি না তোকে কি দেবো (কুকুরের প্রতি। এখানেও একটা কুকুর আমাদের ফলো করে ওঠা-নামা করেছিলো পুরো রাস্তা, বদলে বিস্কিট পেয়েছিলো) ওগো তুমি আবার যাচ্ছো কোথায় আমায় ধরো সাধ করে নামাবে ওঠাবে না ওরে বাবা ক্কি গরম...’ (ভুল লিখিনি, সত্যিই কথা-গুলোয় দাঁড়ি-কমা ছিলো না) তার উত্তরে ত্যাঁদড় ছেলে- ‘এহ্‌, ওদিকে মারবে, আর এখন বাবা-সোনা...’ একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বিশ্বাস করুন!

সেদিন রাতে আমাদের আর শক্তি ছিলো না শরীরে। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি তাড়াতাড়ি। পরদিন সকালে উঠে নিচের ঘরে গিয়ে শুনলাম আরেক ক্যামেরা-উৎসাহী ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে ছাদে ঘুরে সূর্যোদয় দেখেছে, দূরে বরফ-ঢাকা পাহাড় চুড়ো দেখেছে- সব মিলিয়ে বেজায় উত্তেজিত।

আজকেই চলে যেতে হবে, তাই তড়িঘড়ি প্রাতরাশ সেরে আমরা গেলাম লাভার বৌদ্ধ মঠ দেখতে। ‘Kagyu Thekchen Ling Monastery’ আর ‘The Rigpe Dorje Institute’. আগেও এসেছি এখানে। একই রকম সুন্দর। বেশি বর্ণনা করবো না। শুধু একটাই অনুরোধ- দয়া করে অনেকে মিলে দল বেঁধে গেলে সবাই একটুক্ষণ শহুরে অভ্যেস ত্যাগ করে চুপ করে থাকবেন। কথা দিলাম, বেশি ভালো লাগবে। আমাদের এবারের ঘোরাটাই প্রায় মাঠে মারা যাচ্ছিলো একদল কলকণ্ঠ বাঙালির কল্যাণে। শেষে নিজেরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে রেহাই পাওয়া গেলো। কি আর বলবো, ছোট ছোট লামারা পড়তে বসেছে ক্লাসে, তার পাশ দিয়ে হ্যা হ্যা করে ঘোরা, খ্যাচ্‌ খ্যাচ্‌ ছবি তোলা, নিজেকে ট্যুরিস্ট ভেবে খারাপই লাগছিলো।

সেদিনই দুপুরে আরও কিছু অ্যাডভেঞ্চার শেষে আমরা উঠে পড়লাম ফিরতি গাড়িতে, আবারও আসার প্রতিশ্রুতি জপতে জপতে। লাভা এত ঠাণ্ডা হলে না এসে পারা যায়!

***********************

যারা এখনই ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, ১৫ জুন থেকে ট্যুরিস্ট সিজন বন্ধ। আবার খোলে সেপ্টেম্বর মাসে। তবু ফোন করে যাওয়াই ভালো। হোটেল অজস্র। Orchid হোটেলে ঘরভাড়া ৭০০-৯০০/-, খাওয়ার খরচ পাহাড় বলেই একটু বেশি কিন্তু টাটকা আর খুব ভালো খেতে। ওই হোটেলের নিজস্ব রেস্তোঁরা আর দোকান আছে। প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই সেখানে পাওয়া যায়। ওখান থেকে কাছাকাছি ঘোরার জন্য গাড়িভাড়া পাওয়া খুব সোজা। রাস্তার উলটোদিকেই সিন্ডিকেট। সেখান থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা হয়। তাই ঠকার কোন ভয় নেই। আমরা কলকাতা থেকে নন-এসি ট্রেনে করে যাতায়াত করেছি, ফলে এই দুর্মূল্যের বাজারেও সব মিলিয়ে জন-প্রতি খরচ হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের কম (নিজেদের খরচ কমাতে পারলে এর থেকেও কম লাগবে, বলাই বাহুল্য)- মোদ্দা কথা, সপ্তাহান্তে পাহাড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে লাভা আদর্শ। এবার তো আমরা লোলে-গাঁও বা অন্য সব কাছাকাছি জায়গায় যাইইনি। একটু বড় ট্যুর করতে চাইলে সে আরও ভালো।

***********************

No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P