Tuesday, April 10, 2012

নতুন কলম

ধরা যাক, আমি আপনি খুব বন্ধু- একসঙ্গে মদ খাই। এবার ধরুন, দু’জনেই চা খেতে বসে বাঘ-সিংহ মারতে পছন্দ করি আর হিন্দি সিনেমার ভক্ত। শুধু আমাদের হরিহর ইমেজের একটাই কলঙ্ক- আমি ভু-ওয়ান আর আপনি রা-ওয়ান এর ভক্ত। ব্যস! হয়ে গেল। আমরা সন্তর্পণে এই একটি বিষয় এড়িয়ে চলি। পাছে হাতাহাতি হয়! কেন হয়? আমরা সবাই জানি ওই খানেরা আমাদের মত চুনোপুঁটিদের পোঁছেও না। তবু, সমর্থনের সীমা ছাড়িয়ে আমরা অন্যের মত বদলের চেষ্টা কেন করি? কেন আমাদের মনে হয় যে প্রিয় নায়কের সমালোচনা আদতে আমাদেরই সমালোচনা?

বেশ, তা না হয় হলো। মেনে নেওয়া গেল যে মানুষ জীবজগতের নিয়ম মেনেই territorial, আর মগজ-প্রধান প্রাণী হওয়ার কারণে আমাদের মতামত আসলে আমাদেরই উপস্থাপিত করে। কিন্তু এবার আর একটু এগিয়ে ধরা যাক, সেই সমর্থনের কারণে একদিন রাস্তায় আমার-আপনার মধ্যে লেগে গেল তুমুল মল্লযুদ্ধ, যারে সাদা বাংলায় মারামারি কয়। আমরা, দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, নির্মম ভাবে মারতে শুরু করলাম একে অন্যকে। উদ্ভট কল্পনা মনে হচ্ছে? দেখেছেন কোনদিন ময়দানে বড় ম্যাচ? দলে পড়ে আপাত নিরীহ ছাপোষা লোকটাও কি রকম খিস্তি, পারলে মার দিতে পারে, দেখেছেন? সুতরাং, একই রকম সমর্থনের কারণে আমাদের একে অন্যকে আঘাত না করার কোন কারণ নেই। এবার চলুন আরো একটু এগিয়ে যাই। ধরা যাক আমার ছেলে-বউ, আমার সঙ্গে থাকার কারণে (মানে হয় আমায় ভয় পেয়ে, নচেৎ মৎকৃত মগজধোলাই) খান নং এক কে সমর্থন করে। আপনার ঘরেও একই গল্প, তবে তা খান নং দুই কে নিয়ে। আমাদের তুমুল মারামারির পরে যার যার বাড়ি ফিরে আমরা রাগে গরগর করলাম, শপথ নিলাম যে কোন দিন একে অন্যের বংশের মুখ দেখবো না, দুই পরিবারের মধ্যে যে বিবাহের পরিকল্পনা সন্তান জন্মের পরই আমরা করে নিয়েছিলাম, পাত্র-পাত্রীর মতের অপেক্ষা না করে, (সেটাও অবশ্য ওই হিন্দি সিনেমা দেখারই ফল) সে প্ল্যানএ জল তো পড়লই, এমনকি আপনার শালার মেয়ে ইদানীং আমার পিসতুতো বোনের ছেলের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করছে শুনে মেয়েটাকে পিটিয়ে কালশিটে ফেলে দিলেন। সেই খবর শুনে ছেলে যখন আমার পায়ে ধরে কেঁদে পড়লো, “মামা, ও না বাঁচলে আমিও বাঁচবোনা” বলে, প্রবল রেগে আমিও আমার নার্সারির ক্লাসমেট, এখন স্মাগলিং করে পাড়ার ‘মেটে মস্তান’ বলে সুবিদিত লোকটিকে গিয়ে ধরলাম। ফলাফল, একমাসের মধ্যে মেয়েটির মুখে অ্যাসিড, ‘মেটে’র এক হপ্তার জন্য শ্রীঘরবাস, আপনি গুন্ডা লাগিয়ে আমার স্ত্রীকে হেনস্থা, তিনমাসের মাথায় ‘তোর বাবা বেজন্মা’ বলায় আপনার ছোট ছেলের মুখ ফাটিয়ে দিল আমার বোনপো... কি? আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে? এসব হতেই পারে না? আমি তিলকে তাল করছি? আজ্ঞে না। আপনি না করুন, আপনার পরিচিতদের মধ্যে একজন আছেনই, যিনি সদৃশাবস্থায় এমন আচরণ করতেই পারেন। কারণ হয়তো কোন ‘খান’ নয়। কিন্তু একই রকম অপ্রয়োজনীয় এক ধারণা। কি সেটা? সেইটাই আজ আর ভবিষ্যতে বেশ কিছু দিন আমার আলোচ্য বিষয়।

আমরা সব শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট লোক। আমরা বাড়ির ছোটদের শেখাই- খাবার নষ্ট কোর না- কারণ অনেকে খেতে পায় না। সমাধান, পাতের খাবার টা খেয়ে ফেল। কিন্তু, সেই ছোটই যখন দেখে ভিখিরি দেখে তার বাবা-মা দূর দূর করে খেদিয়ে দিচ্ছে, ঠিক কি ভাবে কে জানে? ভিখিরিদের ক্ষিদে পায়না বলে ভাবে বোধহয়। আমরা ঝগড়া করা খারাপ মনে করি, গার্ল-ফ্রেন্ডরা আমাদের ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে, জলের লাইনে কাজের মাসির সঙ্গে, মেট্রো টিকিটের লাইনে মোটা লোকের সঙ্গে তকরার করতে বাধা দেয়। আমাদের পক্ষে কি আমির- সলমন-শাহরুখ নিয়ে ঝগড়া করা শোভনীয়, নাকি বিবেচকের লক্ষণ? কেউ করে? গোটা দেশে? অমন নির্বোধ দু’একটা থাকতেই পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষ কখনোই এমনটা করেনা, তাই না?

এই লেখাটা পড়ছেন মানে আপনার জীবদ্দশায় বেশ কিছু এমন ঘটনা ঘটে গেছে। গোধরার নাম শুনেছেন, সেই যেখানে এক ট্রেন লোককে জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? প্রতি বছর আপনার গর্বের দেশে, (এত গর্বের, যে সিনেমা হলে সারাদিনের খাটনির শেষে নাইট-শো তেও যখন ঝ্যাপ্পোর-প্যাপ্পোর করে জনগণ বেজে ওঠে, উঠে না দাঁড়ালে সব্বাই কটমট করে তাকায়। কিন্তু রাস্তায় থ্যাক করে থুতু ফেললে অন্য দিকে ঘুরে যায়। কোনটা যে বেশি দেশপ্রেম, এখনো বুঝিনি।) ঠিক কতগুলো বোমা ফাটে বলুন তো? ফচকে হাসি হেসে যদি বলেন, “কালিপুজোর গুলো যোগ করলে তো অগুন্তি দাদা-” তবে নিজের বোধ আর শিক্ষার নিদারুণ অভাব প্রকাশ হয়ে পড়বে, তাই চুপ করাই ভাল। আমি সেই বোমার কথা বলছি, যা ফাটলে লোকে চমকায় না, টসকায়। ঠিক কতগুলো লোক মারা গেছিল, গুজরাতের দাঙ্গায়? মনে রাখিনি, আসলে শান্তশিষ্ট লোক তো... কিন্তু এটা মানেন তো, যদি নিজের বাড়ির সামনে কোনদিন দাঙ্গা বাধে, (বাধতেই পারে, এখনো পার্টিশনের সময়ের স্মৃতি অক্ষত থাকা বা অন্য যে কোন কারণেই হোক, এখনো যে বাধেনি এটাই আশ্চর্যের) চেনা অনেকগুলো মুখকে আর চিনতে পারবেন না? ‘বম্বে’ সিনেমা টা দেখেছেন? বা ‘হে রাম’? আমার-আপনার মুখোশ গুলো খসে গেলে ঠিক একইরকম কুৎসিত জানেন তো?

আচ্ছা, ওই বিভীষিকা গুলো কি কারণে হয়েছিলো? একদল নির্বোধের শাহ্‌রুখ আর আরেকদলের আমিরকে সমর্থন করার জন্য নিশ্চয়ই নয়। কেন তবে? অনেক গভীর কারণে? প্রজাতিগত ভাবে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল বলে? খেতে পাচ্ছিলাম না বলে? ফরাসী বিপ্লবের মত জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ? বাজে বকবেন না। প্রতিটা বোমা ফাটে আসলে কিছু লোকের বিকৃত মানসিকতার ফলে, প্রতিটা দাঙ্গা আসলের আমাদের অন্তর্গত হিংসের প্রেশার-কুকার ফেটে যাওয়ার ফল। কিন্তু সে কথা আমরা সবাই জানি, তাই পারতপক্ষে কখনো ভাবিনা, চেপে রাখি, ভুলে যাই। কিন্তু আসল কারণ যাই হোক, ঠিক কি অজুহাতে ওই সব হয় বস্‌? সচিন- লারা, আমির-শাহরুখ, নাকি ক্রিকেট-ফুটবল? ঘটি-বাঙাল? বাঙালি-পাঞ্জাবি? কোন বিভাজন, কোন মত-পার্থক্যই আমাদের এতটা হিংস্র করে তুলতে পারেনা, যতটা পারে আমাদের ধর্ম আর রাজনীতি। দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে কবি যা-ই বলুন না কেন, আমরা এখনো নাবালকের মতো চিন্তা করি। দেশের বেড়া ভাঙতে আমরা আজও পারিনি, দলের বেড়াও নয়। কিন্তু এ সব সমর্থন যতই ভিত্তিহীন হোক, বাস্তবের থেকে বহুদূরের নয়। কোন এক দল বা ব্যক্তিকে সমর্থন করা, ভোট দেওয়া, বিরোধিতা করা- এমনকি কোন নায়ক কে পছন্দ করাও আমাদের অধিকার। কোন এক দল ক্ষমতায় এলে ধরুন আমার আপনার সমূহ ক্ষতি- সে খাজনা বেড়ে যাওয়াই হোক বা প্রাথমিক শিক্ষার প্রগতি। সে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, সব আমি ভাল বুঝিওনা, কিন্তু অন্য কারণটা? ধর্ম? সেটাকে ভিত্তিহীন বললে সকলে রেগে যায় কেন বলুন তো? এই যেমন এখন আপনি রেগে মাথা নাড়ছেন। ধর্ম কথাটা, অন্য অনেক বিষয়ের মতোই, আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি র অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ধর্মের অনেক সুবিধেবাদী সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে, সে সমস্ত নিয়ে কেউ আর আজকাল বিশেষ মাথা ঘামায় না। এমনকি, ধর্মপালন, প্রসার, প্রচার –এসব নিয়েও আমরা, ‘আধুনিকমনস্ক’রা তেমন চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছি। তবু এখনো যখন কালিপটকার আওয়াজে গুলি ভেবে চমকে ওঠে মুম্বইয়ের মানুষ- প্রশ্ন জাগেনা? ঠিক কি এর কারণ? কেন জগতে কিছু মানুষ এই নিয়ে হত্যাপ্রবণ? সত্যিই কি কিছু প্রয়োজন আছে এই ‘ধর্মের’? পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম এককথায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলে( বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম বলেনা বটে, তবে এদের কোন্‌ চেহারায় বর্তমানে মানা হয় বলুন তো? আবার তাদের আসল চেহারায় ওই সব ধর্ম আরো অনেক আজগুবি কথা বলে, সেসবই বা কেন মানবো?)।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি সব ধর্মের মূল কথা হয়, আর সেই সব মূল কথা যদি বিশ্বাসের ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে থাকে, তবে কেন এই ঝামেলা বলুন তো? ধর্মের উৎস কি? বিধেয়? এই রকম সব রকম প্রশ্নের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম আলোচনা করবো, তর্ক করবো এই কলমে। উচন্ড fanaticism থেকে নির্বিষ গোপন ধর্মাচরণ, সব কিছুর ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি নিয়ে এই নাগরদোলায় ওঠা-নামা করবো এই কলমে। প্রথম লেখা ‘অমুক’ এর। আজকেই বেরিয়েছে- পড়ে দেখুন।

No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P