১
‘জেম্মা, জেম্মা’ করে পাগল করে দেয় মেয়েটা। নিজে কিচ্ছুটি নাড়বেননা, কোন কাজে হাত দেবেননা, সব কিছু বলে দেবে, করে দেবে ‘জেম্মা’।
বছর খানেক আগে অবধি খাইয়ে দিতেও হতো, একদিন মায়ের তুমুল বকা খেয়ে থেমেছে সেই আদিখ্যেতা। ছোটোখাটো মেয়ে, ড্যাবডেবে চোখ, প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যাকা- ঠিক যেমনটা ওই বয়সী ছেলেদের ভাল লাগে, তেমনই। আমারও কি আর ভাল লাগেনা? বেশ লাগে। নিজের মেয়ের মতোই আদরে রেখেছি ওকে। তবে নিজের হলে কি আর এত আদর দিতাম, কে জানে? নিজের ছেলেটি তো ষোল বছর বয়েস থেকেই লায়েক। পাড়া বেড়িয়ে
আর ড্রাম বাজিয়ে সময় কাটিয়ে এখন চাকরির বদলে পার্টি করে। দোষ দিইনা। বাবা মা দু’জনেই চাকরি করলে সন্তানের ওপর দিয়ে কি যায় জানি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ড্রাগ-টাগ ধরেনি। চিরকালই বাউন্ডুলে। শুধু গত বছর ওর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে কতক গম্ভীর হয়েছে। তবু সারাদিন বাড়ির বাইরেই থাকে। আমার পেনশনের টাকা আর এতদিনের জমানো টাকার সুদে সংসার ভালই চলে। সংসার মানে যদিও যৌথ সংসার। দেওর কিছু করেননা, কিন্তু ছোট জা বিরাট ব্যবসায়ী। ঘরোয়া সেলাই থেকে শুরু করে এখন টেলারিং এর বেশ বড় ব্যবসা। হেঁসেল আলাদা হলেও ‘ও’র মৃত্যুর পর থেকে সব খরচাই এখন একসঙ্গে হয়। মেয়েটারও দোষ নেই। মা মোটে সময় দিতে পারেনা আর বাবাটি তো অপোগন্ড। কলেজ ফেরতা আমার সঙ্গেই সময় কাটায়।
বেশ চলছিল। রুটিন পাল্টালো গত এপ্রিল মাস থেকে। মেয়ে দেরি করে ফেরা শুরু করলো। দেরি বলে দেরি, একেবারে রাত আটটা-নটা। কোন কোনদিন আগে থেকে বলে রাখলেও বেশিরভাগ দিনই বলতে ভুলে যায়। খাবার করে রাখা থাকে, খায় না- বাইরে থেকে খেয়ে আসে। দোষ করেছে বুঝতে পারলে গলা জড়িয়ে আধো আধো গলায় রাগ ভাঙাতে চেষ্টা করে। বুঝতে কিছুই বাকি থাকে না। এ বয়স তো নিজেরাও কাটিয়ে এসেছি- হলোই বা তিনযুগ আগের কথা। উইক-এন্ডে জন্মদাত্রী এসে খোঁজ নেয়- কেমন আছে মেয়ে। নিজে থাকতে না পারার গ্লানি চাপা দেয় রাজ্যের জিনিস কিনে দিয়ে। মনে মনে ভাবি- আদরে বাঁদরি করছো করো, এরপর যখন নিজের জন্যে সত্যিকারের বাঁদর নিয়ে এসে হাজির হবে, তখন আবার ‘জেম্মা’কে দায়ী করোনা যেন!
দিন যায়, মাস যায়। হাসি খুশি মেয়ে গম্ভীর হতে শুরু করে। এখন তো আবার নতুন দিনের নতুন আপদ ‘সেলফোন’।
সারাদিন ওই মুখে-নয় কানে নিয়ে বসে থাকে। চাপা গলায় ঝগড়া করে। আবার রাগ ভেঙে হেসে ওঠে। কখনো কখনো শব্দ পাই- বাথরুম থেকে ফোঁপানোর। শুনেও না শোনার ভান করি। কচি বুকের লাব-ডুব আমি বুঝতে হয়তো পারি, কিন্তু অনুভব করার শক্তি তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে। দিন-রাত্রির মতো হাসি-কান্নার নাগরদোলায় একটু খালি ফাঁকা লাগে- মেয়ে আজ অনেকদিন ‘জেম্মা’ বলে জড়িয়ে ধরেনি।
গতকাল রাতে অবশেষে নামলো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। আকুল হয়ে কেঁদে ভাসালো আমার কোল। অজস্র ফোঁপানি আর হেঁচকির মধ্যে যা শোনা গেল, তা আর রাষ্ট্র করে ওইটুকু মেয়েকে বাজারি করবো না। এটুকু জানলেই যথেষ্ট, যে আর পাঁচটা গল্পের মতোই ছেলেটা নেহাত ‘বাঁদর’।
ওর কষ্ট দেখে চোখে জল আসছিল বটে, তবে স্বার্থপরের মতো এ কথাও উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মনে, যে আরও কিছুদিন অন্তত ‘জেম্মা’কে ছাড়া তোমার চলবে না। তুমি আর কি করে বুঝবে বল, আসলে জেম্মারই তোমাকে ছাড়া চলে না?
মাঝরাতে কান্না থেমে যাওয়ার অনেক পরে মেয়ে একবার চোখ তুলে জিগ্যেস করলো, ‘জেম্মা, তোমার জেঠুকে মনে পড়েনা? মনে হয় না এখন জেঠু বেঁচে থাকলে কি ভালই না হতো?’
মৃদু হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মেয়েও শান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো। আমি পাশে জেগে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, অপেক্ষায় আছি, আবার পরে কবে এই একই প্রশ্ন করলে সত্যিটা বলবো।
‘জেম্মা, জেম্মা’ করে পাগল করে দেয় মেয়েটা। নিজে কিচ্ছুটি নাড়বেননা, কোন কাজে হাত দেবেননা, সব কিছু বলে দেবে, করে দেবে ‘জেম্মা’।
বছর খানেক আগে অবধি খাইয়ে দিতেও হতো, একদিন মায়ের তুমুল বকা খেয়ে থেমেছে সেই আদিখ্যেতা। ছোটোখাটো মেয়ে, ড্যাবডেবে চোখ, প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যাকা- ঠিক যেমনটা ওই বয়সী ছেলেদের ভাল লাগে, তেমনই। আমারও কি আর ভাল লাগেনা? বেশ লাগে। নিজের মেয়ের মতোই আদরে রেখেছি ওকে। তবে নিজের হলে কি আর এত আদর দিতাম, কে জানে? নিজের ছেলেটি তো ষোল বছর বয়েস থেকেই লায়েক। পাড়া বেড়িয়ে
আর ড্রাম বাজিয়ে সময় কাটিয়ে এখন চাকরির বদলে পার্টি করে। দোষ দিইনা। বাবা মা দু’জনেই চাকরি করলে সন্তানের ওপর দিয়ে কি যায় জানি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ড্রাগ-টাগ ধরেনি। চিরকালই বাউন্ডুলে। শুধু গত বছর ওর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে কতক গম্ভীর হয়েছে। তবু সারাদিন বাড়ির বাইরেই থাকে। আমার পেনশনের টাকা আর এতদিনের জমানো টাকার সুদে সংসার ভালই চলে। সংসার মানে যদিও যৌথ সংসার। দেওর কিছু করেননা, কিন্তু ছোট জা বিরাট ব্যবসায়ী। ঘরোয়া সেলাই থেকে শুরু করে এখন টেলারিং এর বেশ বড় ব্যবসা। হেঁসেল আলাদা হলেও ‘ও’র মৃত্যুর পর থেকে সব খরচাই এখন একসঙ্গে হয়। মেয়েটারও দোষ নেই। মা মোটে সময় দিতে পারেনা আর বাবাটি তো অপোগন্ড। কলেজ ফেরতা আমার সঙ্গেই সময় কাটায়।
বেশ চলছিল। রুটিন পাল্টালো গত এপ্রিল মাস থেকে। মেয়ে দেরি করে ফেরা শুরু করলো। দেরি বলে দেরি, একেবারে রাত আটটা-নটা। কোন কোনদিন আগে থেকে বলে রাখলেও বেশিরভাগ দিনই বলতে ভুলে যায়। খাবার করে রাখা থাকে, খায় না- বাইরে থেকে খেয়ে আসে। দোষ করেছে বুঝতে পারলে গলা জড়িয়ে আধো আধো গলায় রাগ ভাঙাতে চেষ্টা করে। বুঝতে কিছুই বাকি থাকে না। এ বয়স তো নিজেরাও কাটিয়ে এসেছি- হলোই বা তিনযুগ আগের কথা। উইক-এন্ডে জন্মদাত্রী এসে খোঁজ নেয়- কেমন আছে মেয়ে। নিজে থাকতে না পারার গ্লানি চাপা দেয় রাজ্যের জিনিস কিনে দিয়ে। মনে মনে ভাবি- আদরে বাঁদরি করছো করো, এরপর যখন নিজের জন্যে সত্যিকারের বাঁদর নিয়ে এসে হাজির হবে, তখন আবার ‘জেম্মা’কে দায়ী করোনা যেন!
দিন যায়, মাস যায়। হাসি খুশি মেয়ে গম্ভীর হতে শুরু করে। এখন তো আবার নতুন দিনের নতুন আপদ ‘সেলফোন’।
সারাদিন ওই মুখে-নয় কানে নিয়ে বসে থাকে। চাপা গলায় ঝগড়া করে। আবার রাগ ভেঙে হেসে ওঠে। কখনো কখনো শব্দ পাই- বাথরুম থেকে ফোঁপানোর। শুনেও না শোনার ভান করি। কচি বুকের লাব-ডুব আমি বুঝতে হয়তো পারি, কিন্তু অনুভব করার শক্তি তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে। দিন-রাত্রির মতো হাসি-কান্নার নাগরদোলায় একটু খালি ফাঁকা লাগে- মেয়ে আজ অনেকদিন ‘জেম্মা’ বলে জড়িয়ে ধরেনি।
গতকাল রাতে অবশেষে নামলো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। আকুল হয়ে কেঁদে ভাসালো আমার কোল। অজস্র ফোঁপানি আর হেঁচকির মধ্যে যা শোনা গেল, তা আর রাষ্ট্র করে ওইটুকু মেয়েকে বাজারি করবো না। এটুকু জানলেই যথেষ্ট, যে আর পাঁচটা গল্পের মতোই ছেলেটা নেহাত ‘বাঁদর’।
ওর কষ্ট দেখে চোখে জল আসছিল বটে, তবে স্বার্থপরের মতো এ কথাও উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মনে, যে আরও কিছুদিন অন্তত ‘জেম্মা’কে ছাড়া তোমার চলবে না। তুমি আর কি করে বুঝবে বল, আসলে জেম্মারই তোমাকে ছাড়া চলে না?
মাঝরাতে কান্না থেমে যাওয়ার অনেক পরে মেয়ে একবার চোখ তুলে জিগ্যেস করলো, ‘জেম্মা, তোমার জেঠুকে মনে পড়েনা? মনে হয় না এখন জেঠু বেঁচে থাকলে কি ভালই না হতো?’
মৃদু হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মেয়েও শান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো। আমি পাশে জেগে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, অপেক্ষায় আছি, আবার পরে কবে এই একই প্রশ্ন করলে সত্যিটা বলবো।
No comments:
Post a Comment
Give me your thoughts, I will give you replies. :P