Tuesday, December 13, 2011

জেঠিমার ঝুলি



আমার নাকি কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতটাই কমে যাচ্ছে, যে কিছুদিন পরে নিতান্ত ভাল-মন্দের বিচারও আর করে উঠতে পারবো না। এই সিদ্ধান্ত আমার নয়, কোন ডাক্তারেরও নয়, শ্রীমতি সবজান্তা তিতিরের। কোন এক সাময়িক পত্রিকায় পড়েছে যে টিভি দেখার সঙ্গে বুদ্ধি কমে যাওয়ার সরাসরি যোগ আছে- ব্যস্‌, বকে বকে কানের পোকা খেয়ে ফেলল। যতই বোঝাই, ওরে, পরের সংখ্যায় দেখবি আবার উল্টো কথা বলেছে, তাও নতুন সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে- কে কার কথা শোনে? ‘সহচরী’ তে লিখেছে মানে ও নিশ্চয়ই বেদেও লেখা আছে। শেষ পর্যন্ত শান্তি রক্ষা করতে মেনেই নিলাম যে আমার বুদ্ধির গ্রাফ নিম্নমুখী। সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলো।

সাময়িক বলছি কেন?

কারণ আছে। এই তর্ক নতুন নয়। আমার মনে আছে, প্রথম যখন টিভি এলো কলকাতায়, নতুন গাড়ির মতো সমাদর পেতো মালিকের কাছে। আমরা যারা অনুষ্ঠান দেখতে পেতাম, তারা নিজেদের বেশ একটা অভিজাত ক্লাবের সদস্য মনে করতাম। তার একটা কারণ অবশ্য একটিমাত্র চ্যানেল আর সব মুখস্থ হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠান।  সে যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই যখন টিভি বাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে গেল আর গোটা দেশ একসাথে অকেজো হয়ে পড়তে শুরু করলো রামায়ণ, মহাভারত-এর কল্যাণে- একটা ফিস্‌ফাস্‌ শোনা যেতে শুরু করলো- জিনিসটা নাকি মোটেও ভাল নয়। সাহেবরা নাকি এটাকে ‘Idiot Box’ বলে। এটা শোনা ইস্তক একটা ধন্দ ঢুকেছিল মাথায়- ‘Idiot’ টা বলে কাকে, যে দেখছে তাকে, নাকি বাক্স টা নিজেই? তা সে প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক, বলতে আপত্তি নেই, আমি নিজে মোটেও টিভি দেখতাম না- অবশ্যই বুধবারের ‘চিত্রহার’ আর রোববার সকালের ‘রঙ্গোলী’ বাদ দিয়ে। শুক্রবার রাতের হিন্দি সিনেমা দেখার বেশ ইচ্ছে হতো, কিন্তু সেদিন আমাদের নাচের রিহার্সাল থাকতো। অন্যান্য অনুষ্ঠান? সে সব কোনদিন দেখা হয়নি। ওই যে, বোকা বাক্সের অপবাদ। তখনকার দিনে তো চ্যানেল কাকে বলে আমরা জানতাম না, তাই টিভি দেখাটা ওই যাকে বলে 'interactive' হয়ে ওঠেনি। রিমোট কন্ট্রোল বলতে আমেরিকাবাসী তুতুনের ছেলের মহার্ঘ্য খেলনা গাড়ির কথা মনে পড়তো। সন্ধে হলেই পাড়ার সব বাড়িতে জানালায় উঁকি দিলে বোধহয় দেখা যেত কিছু মানুষ স্থাণু হয়ে বসে আছে টিভির সামনে। না, কেউ রিমোটে চ্যানেল বদলাতো না। দেশজোড়া সম্মোহনের কারখানা বসতো।

সে রামানন্দ সাগরও নেই, সেই দূরদর্শনও নেই। এখন মনের সুখে মাতৃভাষায় টিভি দেখা যায়। পছন্দ না হলে অসংখ্য জায়গা আছে যাওয়ার। আমি এখন টিভি দেখি। সারা সন্ধে। প্রতিদিনের রুটিন করা আছে আমার। কিসের পরে কি দেখবো, কবে কি সিরিয়াল আছে, তার রুটিন। নিয়মিত বাধ্য ছাত্রীর মতো বসে পড়ি, আর চলে যাই সাজানো হাসি-কান্নার দেশে। ঠিক এইটেই সহ্য হয়না তিতির মামণির। আপত্তির কারণ? ঐ ম্যাগাজিনে পড়া কারণ ছাড়াও অনেক কিছু। অতই যদি গল্প দেখার শখ, আমি কেন ভাল সিনেমা দেখছিনা, টানা অনেকক্ষণ চূড়ান্ত মেলোড্রামাটিক লম্ফ-ঝম্প না দেখে আমার উচিত তিতিরের বলে দেওয়া ভাল ভাল সিনেমা দেখা, চড়া দাগের আওয়াজ- অভিনয়- শিল্প দেখে দেখে আমার সমস্ত সুকুমার প্রবৃত্তির অচিরেই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে- এইসব আর আরও অনেক কিছু। হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ওর কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ (ছোট হলে কি হবে, মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে)। কিন্তু তা বলে আমি কেন টিভি দেখা থামাবো? আমি তো জানি, ওই একটিমাত্র বোতাম টিপে আমি চলে যেতে পারি বরাহমিহিরের ঘরের ভেতর থেকে কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা জানতে তার নিজের মহল্লায়। নিজের চেয়ারে বসে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাবো এতদিনে যাদের সঙ্গে প্রায় একতরফা সখ্যতা গড়ে উঠেছে, সেই মানুষগুলোর কাছে। তাদের কাউকে কাউকে আমি নিতান্ত অপছন্দ করি, তা-ও। আমাদের ছোটবেলায় মায়েরা দুপুরবেলা হাতের কাজগুলো প্রায় সেরে এনে আড্ডায় বসতেন আমাদের বিরাট শোওয়ার ঘরে, চারপাশে খুঁটি লাগানো বিছানায়। কোন না কোন কাজে তখনও হাত চলতে থাকতো তাঁদের, মুখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। যেসব অমূল্য দিনে ছুটি পড়তো স্কুলে, নানা ছুতো-নাতায় হাজির হতাম সেই সব দ্বি-প্রাহরিক আড্ডায়। আসর ভাঙলেও আমার গল্প খিদে মিটতো না। আর কত রকম গল্পই না ছিল সেই সব বয়স্কার ঝুড়িতে! এক একটা থেকে গোটা গোটা সিরিয়াল হয়ে যেতে পারতো। আজ এতদিন পরেও আমার সেই খিদে একটুও কমেনি। কিন্তু সেই সব আসরের কথা আর কল্পনাতেও আনা যায়না। বিশ্বাস করুন না করুন, শুধুমাত্র সেই কারণেই আমি সিরিয়াল দেখি। শুধু দেখি না, পরের দিনের পর্ব শুরুর আগে নানা সময়ে ভাবতে থাকি সেই গল্পগুলো নিয়ে। যেসব দিন আমার মনের সঙ্গে মিলে যায় সিরিয়ালের গল্প, আজকাল তো সেরকম প্রায়ই হয়, নিজেই বুঝতে পারি আমার চলনে আজ একটু বেশি ছন্দ। যেদিন একদম অন্যরকম কিছু হয়, মনে মনে গাল পাড়ি পরিচালককে।

তিতির জানেনা, আমার মতো বুড়িরও একটু হলেও বুদ্ধি আছে। বুঝতে কি আর পারিনা, কত্তখানি গলদ থাকে ঐ সব সিরিয়ালে? বিলক্ষণ বুঝি। একমাত্রিক চরিত্র, ঘোরানো সিঁড়ির মত প্লট, (অনেকদিন পরে দেখলেও বিশেষ পরিবর্তন বোঝা যায়না, তাই না?), দুম করে অপ্রয়োজনীয় সব ক্লাইম্যাক্স- সব ধরতে পারি। কিন্তু কি করবো? ঐ গুলোই যে ভাল লাগে! গল্পের গরু যদি গাছেই না উঠলো, তবে সেই গল্প শুনবো কেন বলুন দেখি? মাঠে চরা গরু তো আজন্ম দেখে আসছি। আড্ডা বাঙালির কেন এতো প্রিয় বলুন তো?---  অতিরঞ্জন। এককথায়। সেখানে প্রতিদিন সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে ন’টা তো আমার স্বর্গ মশাই!

নিজের মুখে বার বার বললেও জানি, এখনো ততটা বুড়োইনি। সংসারে এখনো দিব্যি কাজে লাগি। যেদিন আর লাগবো না, হয়তো এই তিতিরই একদিন বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে আসবে কোন ‘হোমে’।  রাগ করবো না। একঘেয়েমি কাটাতে তখন কি বসবে আবার দুপুর বেলা, সেই বৈঠকগুলো, কিছু বুড়োবুড়ির গল্প নিয়ে? এই জীবনে গল্প তো কিছু কম জমেনি- কিছু দিনের জন্য হলেও শ্রোতা পাবো না কয়েকজন? মনের সুখে, নিজের রঙে রাঙাবো তখন সেই গল্প গুলো। অবিশ্বাস মেশানো মুগ্ধতা ঘিরে ফেলবে আমার চারপাশে ঘিরে বসা তিন-চার কুড়ি বয়সের মানুষদের। গল্প শেষে মায়ের মতোই বাঁকা হাসি হেসে এক ভ্রূ তুলে উঠে যাবো জানালার দিকে, প্রচ্ছন্ন অবহেলায়। নিশ্চিত, আমার দিকেই আটকে আছে বিমুগ্ধ বেশ কিছু চোখ।

আশা করি বললে ভুল হবে, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে দোষ কি?

No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P