Tuesday, December 13, 2011

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে...



আসল নামটা নাহয় না-ই বললাম। ধরে নিন ওর নাম তিতির। ওই যে আমায় ‘জেম্মা’ বলে ডাকে আর কি। আগের দিন বলছিলাম না, আমাদের দুই অসমবয়সী বন্ধুর সুখ-দুঃখের কথা- শেষ করেছিলাম স্বগতোক্তি দিয়ে। আজ তার ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। সত্যিটা খুব পরিষ্কার। ওর জেঠু বেঁচে থাকলে মোটেই ভাল হতো না। অন্তত আমার পক্ষে। না, লোকটা খারাপ ছিলো না। ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম। তখন কথায় কথায় জীবন শেষ হওয়ার কথা ভাবতাম। জীবনের বিশেষ দাম ছিলো না। ‘ওকে ছাড়া বাঁচবো না’, ‘কলকাতা ছাড়লে বাঁচবো না’, ‘নাচ ছাড়লে মরে যাবো’- এইসব। যারা মুখ বেঁকিয়ে বলতো- ও সব বিয়ের পরে জানালা দিয়ে পালাবে- তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলতাম, ‘এত তীব্র আমার অনুভূতি, খামোকা পাল্টাতে যাবে কেন? দেখিয়ে দেবো আমার ধৈর্য আর ভালবাসার কত জোর।’ তখন শুধু একটা জিনিসই বুঝিনি- জীবন ঠিক কতটা লম্বা। প্রতিদিনের আণুবীক্ষণিক পরিবর্তন প্রয়োজনমতো সময় পেলে ‘অতীত আমি’ আর ‘ভবিষ্যৎ আমি’র মধ্যে ঠিক কতটা তফাৎ গড়ে তুলতে পারে- বিশ্বাস করুন, বুঝিনি। ভালবাসায় যে সম্পর্কের সূত্রপাত, তা যে অন্য সব সম্পর্কের থেকে অনেক বেশি দাবি করে, তাও বুঝিনি। যে সহনশীল, চনমনে, দায়িত্ববান যুবককে ভালবেসেছিলাম, সে যে ঠিক কবে এক গম্ভীর, নিয়ন্ত্রণাসক্ত, রসবোধহীন ‘স্বামী’তে পরিণত হয়েছিল, জানিনা। তা-ও, অতীত প্রেমের স্মৃতি, অভ্যেস আর এক অনুচ্চারিত আশাবোধ থেকে বিয়েটা ভাঙিনি। বিদ্রোহ করেছিলাম, নিজের মতো করে।

আমি নাচতাম। কুচিপুড়ি। ভালই নাচতে পারতাম। আমাদের দলটায় স্বভাবতই মেয়ে বেশি ছিলো। কিন্তু দলের পান্ডা ছিলেন অবিনাশদা। ঋজু দীর্ঘ শরীর, মেদহীন- গায়ের রঙ সামান্য চাপা। নাচতেন বলে ওই যুগেও ‘waxing’ করাতেন পুরো ঊর্দ্ধাঙ্গে। কাউকে কখনো সে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে শুনিনি- এতটাই ভাল পারতেন নিজের কাজ। ‘নটরাজ নৃত্য’ করলে অবিনাশদা ছাড়া কাউকে শিব বলে ভাবাই যেত না। আমি, রোহিনী আর অম্বালী ঘুরে ফিরে পার্বতী হতাম। আমার পালা যেদিন থাকতো, সেদিন সকাল থেকে অপেক্ষায় থাকতাম। সকলে বলতো, আমি নাকি নাচের সময় বিভোর হয়ে যাই- দর্শকের উপস্থিতি নাকি আমার মতো করে কেউ ভুলতে পারেনা। আসলে আমি জানি, ওই সময়টুকু সত্যিই নিজেকে পার্বতী মনে করতাম। উদ্দাম নৃত্যের শেষে স্পটলাইটের নিচে আমার কোমর জড়িয়ে বাঁ পা আর হাত ঊর্দ্ধমুখে তুলে ধরতেন অবিনাশদা আর অত কাছ থেকে পুরুষালি ঘামের গন্ধ, ফিল্টার উইলস্‌ এর গন্ধ আর আতরের গন্ধ মিশে আমার চতুর্দিকে গড়ে উঠতো সত্যিকারের কৈলাস, তা সে হোক না এক মুহূর্তের। এর আগে কখনো ভাবিনি পুরুষের ঘামের গন্ধ এমন মাতাল করতে পারে। আমি অবিনাশদার পার্বতী হতে চেয়েছিলাম।

পারিনি, কারণ আমার ‘স্বামী’ কখনো কোন ভুল করেনি। অসম্ভব বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন, নির্বিকার একজন মানুষ, কিন্তু শেষ অবধি সে পরিবারের কথাই ভাবতো। নাচের বয়স পেরিয়ে গেলে নিজের উদ্যোগে যোগাযোগ রেখেছিলাম বছর দুয়েক, ক্লাবের কচিকাঁচাদের তালিমও দিয়েছি। কিন্তু বেশিদিন সহ্য করতে পারিনি নিজের স্বপ্নের পুরুষের সঙ্গে হাঁটুর বয়সী মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হয়ে নাচতে দেখতে। হ্যাঁ, অবিনাশদার চুলে সামান্য পাক ধরা ছাড়া, যা সযত্ন কলপের নিচে থাকতো, বয়স বিশেষ বাড়েনি।

আপনারা বোধহয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে এক অতি সাধারণ প্রেমের গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলছি। না, তা নয়। তিতিরের প্রশ্নের উত্তরে আমি যে সত্যিটা বলবো ভেবেছিলাম, তার কারণ অবিনাশদা নন। আমি ‘বিধবা’ হওয়ার সময় জগতের এতটা দেখে ফেলেছিলাম, যে কোন একজন সাধারণ পুরুষকে ভালবাসা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। আমি একাই সুখী ছিলাম, আজও আছি। অন্যের সংসার, অন্যের সন্তানকে আপন করে নিয়ে এই বেঁচে থাকা আপনার কাছে অর্থহীন হতেই পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি সুখী। তার একটা কারণ হয়তো আমি স্বাধীন। তিতিরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর ছিলো, ‘না, জেঠু বেঁচে থাকলে একটুও ভাল হতো না। এই বেশ ভাল আছি।’

শুধু মাঝেমধ্যে লোডশেডিং এর সময় মোমবাতির আলোয় ঘূর্ণি খাওয়া পোকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবিনাশদার কথা মনে পড়ে...

No comments:

Post a Comment

Give me your thoughts, I will give you replies. :P